বারবার সরকার পতনের পর আঘাত এসেছে জাতীয় সঙ্গীতের ওপর

মাহমদু সালেহীন খান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শুধুমাত্র সুর এবং গানের কথার চেয়ে জাতীয় সংগীত অনেক বেশি কিছু বহন করে। এটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের প্রতীক। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বেশ কয়েকটি দেশ সমসাময়িক মূল্যবোধ এবং জাতিগত অন্তর্ভুক্তিকে আরো জোরদার করতে নিজ নিজ জাতীয় সংগীতে সংশোধন ও পরিবর্তন আনার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশেও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে আলোচনা এখন তুঙ্গে। মধ্য জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সপ্তাহের ব্যবধানে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসতে থাকে হত্যা-খুন-গুমসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের নজীরবিহীন সব তথ্য। ছাত্র-জনতার সুপারিশে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এসময় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার এবং মেরামতের দাবি জোরালো হয়।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধান পরিবর্তনের দাবি ওঠে। ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দলগুলো যেন ফের স্বেরাচারী হয়ে না উঠতে পারে তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। একই সময় আলোচনায় আসে জাতীয় সংগীতে পরিবর্তনের বিষয়টি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপরই এই প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এরইমধ্যে নেটিজেনরা বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে এখানে সবারই পরামর্শ-দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে। আবদুল্লাহিল আমান আযমী একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন এটি গ্রহণ করা না করার বিষয়ে সরকার আলোচনা করতে পারে। আরেকটি পক্ষ বলছে, জাতীয় সংগীত আমাদের আবেগের জায়গা। এটি পরিবর্তন করার দাবি কিসের ভিত্তিতে তিনি তুলবেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি। এতে স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।’ আমান আযমী বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?

শুধু আব্দুল্লাহিল আমান আযমী নয়, নিজের ভালো লাগা গানের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জাতীয় সংগীতকে টেনে এনে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন তরুণ উদীয়মান শিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল। প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীতের চেয়েও বেশি আবেগময় ও বাংলাদেশকে প্রকাশ করে বলে জানিয়েছিলেন। বিষয়টিকে ব্যক্তিগত মন্তব্য বললেও বিতর্ক এড়াতে পারেননি নোবেল। তার এই মন্তব্যের জেরে দেশব্যাপী তোলপাড় ঘটে। এমনটি ভারতের বাংলা ভাষাভাষিরাও নোবেলের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্যে মেতে ওঠে। তাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলে নেটিজেনরা। নোবেলকে নিয়ে যখন এমন বির্তক চলছে তখন অনেকেই আবার বলছেন, জাতীয় সংগীত নিয়ে শুধু নোবেল একটা মন্তব্যই করেছেন। কিন্তু দেশে বিভিন্ন সময়ে ‘জাতীয় সংগীত’ বদলে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

রাজনৈতিকভাবেই প্রস্তাব আনা হয়েছিল আমার সোনার বাংলা গানটিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে চালু করার। রাজনীতি বিশ্লেষকরা জোর গলায় বলছেন, জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো সংগীতকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকরা বলছেন, দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে। সে কমিটি দুটো গানের একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গান দুটো হলো, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের হালে আর পানি পড়েনি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়।

সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে।

এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। সচিব জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি। প্রসঙ্গত, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। ২০০৬ সালে নেপালের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়। নাজিবাদকে উৎসাহিত করে এমন ইঙ্গিত রয়েছে অভিযোগে জার্মানির জাতীয় সংগীতের কয়েকটি লাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্ণবাদী শাসনের যুগ শেষ হলে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ২০০৪ সালে নতুন একটি সংগীতকে ইরাকের জাতীয় সংগীত হিসেবে সাময়িকভাবে নির্বাচিত করা হয়। তারা এখনো নতুন জাতীয় সংগীত খুঁজছে। আফগান জাতীয় সংগীত এখন পর্যন্ত কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের ঘোষণার পর ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পরিবর্তন হয় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত। নতুন এ জাতীয় সংগীতে অস্ট্রেলিয়াকে ‘ইয়াং অ্যান্ড ফ্রি’ হিসেবে আর অভিহিত করা হবে না। আদিবাসীদের সুদীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানোর অংশ হিসেবেই এ পরিবর্তন। জার্মানি তাদের সমতাবিষয়ক কমিশনার ক্রিস্টিন রোজে-ম্যোরিং জাতীয় সংগীতে আরো বেশি লিঙ্গ সমতা আনার প্রস্তাব করেছেন। সংগীতের যে অংশে ‘ফাদারলান্ড’ অর্থাৎ ‘পিতৃভূমি’ বলা হচ্ছে, সেখানে ‘হাইমাট’ অর্থাৎ ‘জন্মভূমি’ লেখার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তবে চ্যান্সেলর আঞ্জেলা ম্যার্কেলসহ অনেকেই মনে করছেন, জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। ২০১২ সালে লিঙ্গ সমতা আনার জন্য অস্ট্রিয়ার জাতীয় সংগীতে ‘পছলেরা’-এর জায়গায় ‘পময়েরা এবং ছেলেরা’ লেখা হয়েছে। উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডাও সম্প্রতি তাদের জাতীয় সংগীতকে আরো লিঙ্গ নিরপেক্ষ করেছে। সংগীতের দ্বিতীয় লাইনে ‘তোমার সব ছেলেরা’-এর জায়গায় লেখা হয়েছে ‘আমরা সবাই’। নেপালে ২০০৮ সালে নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। তার আগের বছর নেপালে নতুন একটি গানকে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৬২ সালে গ্রহণ করা নেপালের আগের জাতীয় সংগীতে রাজতন্ত্রের প্রশংসা ছিল। তাই এতে পরিবর্তন আনা হয়। আফগাস্তানে বেশ কয়েকবার জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনা হয়। তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে কোনো জাতীয় সংগীতই ছিল না। পরে ২০০২ সালে পুরনো জাতীয় সংগীতকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। পরে ২০০৬ সালে তৎকালীন কারজাই সরকার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে জাতীয় সংগীতও পরিবর্তন করে। আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা দেশটির কথা উঠলেই গণহত্যার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ওই দেশে পাঁচ থেকে ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। গণহত্যা-পরবর্তী রুয়ান্ডার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে দেশটি ২০০১ সালে একটি নতুন জাতীয় সংগীত বেছে নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে আগের দুটি জাতীয় সংগীত থেকে কিছু অংশ নিয়ে নতুন একটি জাতীয় সংগীত তৈরি করে। আফ্রিকান ও ইংরেজি ভাষায় গানটি রচিত। তবে আফ্রিকান ভাষার অংশটি বর্ণবাদ আমলে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীতের অংশ হওয়ায় এর সমালোচনা করেন অনেকে। নেলসন ম্যান্ডেলা সেটি রিকনসিলিয়েটরি ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণবাদণ্ডপরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই তালিকায় রয়েছে রাশিয়াও। ভ্লাদিমির পুতিন ২০০০ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯০ সালের আগে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনেন। তবে গানের কথায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়।