ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সমাধান

ড. হাসিনুর রহমান খান
বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সমাধান

বাংলাদেশে বন্যা একটি নিয়মিত এবং প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা প্রতি বছর দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষকে বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে এমনিতেই অবহিত থাকতে হয়। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষদের এসব বিষয়ে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় না এবং অবহিত থাকতে হয় না। বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর ত্রিভুজ অঞ্চল বা ডেল্টায় অবস্থিত, যা বিশ্বের বৃহত্তম নদী ডেল্টা। এই নদীগুলোর পানি প্রবাহ বাংলাদেশে এসে একত্রিত হয় এবং সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এ কারণে ভারি বর্ষণ, হঠাৎ ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশের নিচু ভূমিতে সাধারণত বন্যা সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক চলমান বন্যা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বর্ষাকাল হয়, তখন মৌসুমি বায়ু দেশজুড়ে ভারি বর্ষণের কারণ হয়। এই সময়ে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, যা নদীর পানি উপচে পড়ার এবং নিম্নাঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করার কারণ হয়। বন্যা শুধু মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত করে না, বরং এর ফলে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হলে বন্যার সময়ে এবং বন্যা-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা চলাকালীন প্লাবিত অঞ্চলের মানুষের সব মৌলিক অধিকারগুলো সাময়িকভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। কিংবা সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে খর্ব করে ফেলে। একবার কি ভেবে দেখেছেন কারো খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, আগুন, পানি, যোগাযোগ ইত্যাদি মৌলিক অধিকার দিনের পর দিন খর্ব হলে কতটা অসহায় যাপিত জীবন চলে? অবিশ্বাস্য হলে এটাই সত্যি যে ভয়াল বানভাসি অঞ্চলের মানুষদের এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। মানুষের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তখন যেন এই অসহায়ত্ব প্রত্যহ জীবনসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। দুর্যোগের প্রতিবন্ধকতাগুলোর কারণে তাদের কাছে সরাসরি সহযোগিতা দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয় না বলে বানভাসি অঞ্চলের মানুষদের অসহায়ত্ব লেগেই থাকে। বন্যার পর সবচেয়ে সাধারণ এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হলো পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। বন্যার পানি মলমূত্র ও অন্যান্য দূষিত পদার্থের সঙ্গে মিশে যায়, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ ছড়ায়। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব পরিবেশগত সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এসব রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ও হেপাটাইটিস-এ ও ই অন্যতম। বন্যার পরে তো বটেই, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা চলাকালীন ডায়রিয়া এবং কলেরা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বন্যার পানিতে মিশে থাকা জীবাণু দূষিত পানীয় জল ও খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, যা ডায়রিয়া ও কলেরার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম সম্পন্ন ব্যক্তিদের, বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের মধ্যে এই রোগগুলো বেশি ছড়ায় এবং কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায়। টাইফয়েড একটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ জনিত রোগ, যা দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যার সময় অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগটি দীর্ঘমেয়াদি জ্বর, পেটের ব্যথা এবং দুর্বলতার কারণ হয়, যা রোগীর স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। হেপাটাইটিস-এ এবং ই হলো লিভারের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যা দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যার সময় এবং পরে পানি ও স্যানিটেশনের সমস্যা থাকলে এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ কারণে ও হেপাটাইটিস-এ এবং ই-তে আক্রান্ত হলে সাধারণত লিভারের ক্ষতি এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়। বন্যার পরের সময়টাতে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বন্যার ফলে পানি জমে থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মশার বংশবিস্তার বাড়ে, যা বিভিন্ন মশাবাহিত রোগ, যেমন- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। বন্যার পর জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তার বেড়ে যায়, যা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটায়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুর বিস্তার যেভাবে ঘটেছে তাতে বন্যা পরবর্তী ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়ে যেতে পারে বন্যাপ্লাবিত শহর অঞ্চলে। ম্যালেরিয়া রোগ অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। বন্যার সময় এবং পরে এই মশার বংশবিস্তার বেড়ে যায়। চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এমনকি বন্যার পর এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত