বাংলাদেশের নবযাত্রা

প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ অনেক

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্র-জনতার অভুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনার পলায়নের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়েস প্রায় ১ মাস হতে চলেছে। গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। জাতির কাঁধের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরাচারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, সে পথের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা ব্যাপক। প্রত্যাশিত পরিবর্তনের জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ১৬ বছরের জঞ্জাল দুয়েক মাসেই সাফ-সুতরো করার কোনো ম্যাজিক কারো হাতেই নেই। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন সঠিক কর্মপন্থা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দৃঢ় পদক্ষেপে তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম মাসের কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে এই প্রতীতি জন্মেছে যে, এই সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। একটি অনির্বাচিত, নির্দলীয় সরকারের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। তবে হাজারো ছাত্র-জনতার রক্ত ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি বিপ্লবী সরকারের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। স্বৈরাচারবিরোধী বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ করে এই সরকার একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে তার অভীষ্ঠ লক্ষ্যে যাত্রা করেছে। এরইমধ্যে দেশের অর্থনীতি এবং রেমিটেন্স প্রবাহে একটি আশাব্যঞ্জক পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। ৫ আগস্টের পর মাত্র ২৫ দিনে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স প্রবাসী কর্মীরা পাঠিয়েছে। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল মেরামত করতে সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা খরচ এবং এক বছর সময় লাগবে বলে হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। সরকারের মেয়াদ একমাস পূর্ণ হওয়ার আগেই মাত্র ৪০-৪৫ কোটি টাকা খরচ করে এই সরকার মেট্রোরেল চালু করতে সক্ষম হয়েছে।

ড. ইউনূসের খ্যাতি, তার মেধা ও প্রজ্ঞার আলো দুর্দিন উত্তরণে জাতিকে পথ দেখাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা নানাভাবে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইন অমান্য করে বাংলাদেশি কর্মীরা ছাত্র আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নেমে আসার অভিযোগে জুলাই মাসে ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল সে দেশের আদালত। ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর সেসব দণ্ডিত বাংলাদেশিদের সাজা মওকুফের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ নাহিয়ান সে আবেদনকে অগ্রাহ্য করেননি। তিনি সাজা মওকুফ করে তাদের দেশে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের একমাসের মধ্যেই অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য একে অনেক বড় একটি কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে গণ্য করা যায়। দেশ থেকে পাচার হওয়া হাজার হাজার কোটি ডলার দেশে ফেরত আনা এই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক লক্ষ্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। ড. ইউনূসের বৈশ্বিক খ্যাতি ও ভাব-মর্যাদা এ ক্ষেত্রে অনেক বড় সাফল্য এনে দিতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, নতুন সরকার ঠিক পথেই চলছে। দেশে-বিদেশে সরকারের আস্থা ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে এই মুহূর্তে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে আরো মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্য দিয়ে ভেঙেপড়া রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রেও কার্যক্রম থেমে নেই। রাষ্ট্র মেরামত তথা সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য ন্যূনতম একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা অপরিহার্য। প্রধান উপদেষ্টা এরইমধ্যে সে লক্ষ্যেও তার কার্যক্রম শুরু করেছেন।

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহযোগিতা-নিস্ক্রিয়তা সত্ত্বেও দেশকে অস্থিতিশীল করতে ভারতের মদদে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের একের পর এক নানামুখী ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এসব মোকাবিলা করেই সরকার সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এরইমধ্যে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলসহ সমাজের অংশীজনদের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ঢাকার শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রসমূহের সম্পদকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্ভাব্য মেয়াদকাল নিয়ে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা দূর করতে সম্পাদকদের পক্ষ থেকে এই সরকারের মেয়াদ ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। সরকার অংশীজনদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখবে। সেই সাথে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া জঞ্জাল সরিয়ে দেশকে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছতার ধারায় এগিয়ে নিতে জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা কমানো হয়েছে। গণপরিবহনের চাঁদাবাজিও অনেকটা বন্ধ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক ফলাফল নিশ্চিত করতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের যানজট, পানিবদ্ধতা, ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামত এবং ব্যাংকিং সেক্টরের তারল্য ও আস্থার সংকট দূরিকরণে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। শহরের চারপাশের নদী, খাল ও জলাভূমি দখল উদ্ধার ও সংস্কারের মতো উদ্যোগগুলো এই সরকারকেই নিতে হবে। অর্থ পাচারসহ বিগত সময়ের বড় বড় কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। যদিও পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। এই বাহিনীর আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্নীতি, লুণ্ঠন, দখলদারিত্ব, দুর্বৃত্তায়ন ও বিচারহীনতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চিরতরে দূর করার কার্যক্রম এই সরকারকেই শুরু করতে হবে। নিরপেক্ষ-নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল দৃঢ়তা ছাড়া রাষ্ট্র মেরামতের মতো কঠিন প্রত্যাশার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে সেই দৃঢ় সঙ্কল্প রয়েছে বলে মুক্তিকামী মানুষের অটুট আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে।