ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঘুষ-দুর্নীতি দূর করতে হবে

ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ঘুষ-দুর্নীতি দূর করতে হবে

কিছু দুর্নীতিবাজ প্রেপ্তার ও অনেকের দেশ ছেড়ে পালানোর ধরন দেখে মনে হয়, নীরব ঘুষ-দুর্নীতির এক সরব বিপ্লব ঘটেছিল। দেশের সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে দিয়েছে দুর্নীতিবাজরা। ঘুষ-দুর্নীতির কোনো রাখঢাক ছিল না, ছিল না কোনো ঘৃণা বা ধিক্কার। তাই ঘুষের চাষাবাদে বাম্পার ফলনের টার্গেট পূরণ হয়েছে! এখন এর পরিসমাপ্তি ঘটানো দরকার। কারটা লিখব? কোনো সেক্টর ঘুষবিহীন কাজ করে? শিক্ষা সেক্টরকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। সাধারণত সেখানে দুর্নীতি করার উপায় নেই। কিন্তু এই সেক্টরে গ্রামের একজন নিরীহ স্কুলশিক্ষক জায়গামতো ঘুষ না দিলে পেনশনের টাকা পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? সারা জীবন সৎ থেকে একজন ভুক্তভোগী বৃদ্ধ শিক্ষকের আঁকুতি- বাবারে, আমি কয়দিন বাঁচব? আমাকে হেড অফিসে ঘুষ দিয়ে পেনশন পাস করাতে বলো না। না খেয়ে মরব, তবু জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে চাই না। তার মতো মহান শিক্ষকের এত পবিত্র উপলব্ধি তো আমাদের সমাজে সবার নেই। আমাদের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঘুষ লেনদেনের প্রতি এতটাই বেপরোয়াভাবে আকর্ষিত হয়ে পড়েছে যে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন। একশ্রেণির মানুষ পেটের দায়ে বাঁচার জন্য চুরি, অর্থ আয় করে তাদের কথা আলাদা। কারণ, সমাজে এদের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু পদধারী, ক্ষমতাধারী লোভী মানুষরা যখন চুরি, জালিয়াতি, মিথ্যাপনা, দখলবাজি, ছলনা ইত্যাদির মাধ্যমে ঘুষের জাল বিস্তার করে চাকরি, পদন্নোতি, বদলি, ছুটি, পেনশন প্রত্যাশী নিরীহ অথবা বেকার মানুষকে সহজে ফাঁদে ফেলে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করে, এটাই ঘুষ। এটাই দুর্নীতির মহামারি। যে কোনো পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করা যাক। ভোট থেকে শুরু করতে পারলে ভালো হতো। যে কোনো পর্যায়ে নির্বাচনের সময় আমাদের দেশের মতো এতো হৈ-চৈ, মারামারি, খুন-খারাবি, ভোটচুরি, জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির অভিযোগ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ঘটে বলে মনে হয় না। এখানে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুধু সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগদান থেকে শুরু করি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁস-কাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও আতঙ্কে রয়েছেন। গত ৩০টি পাবলিক চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করা হয়েছে। গত ১২ বছরে বিসিএস পরীক্ষাসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। ঢাকায় একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে তার। আর গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি। সিআইডি জানিয়েছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। পিএসসির প্রশ্নফাঁস শুরু হয় আগে থেকেই। গত ২৪তম ব্যাচে ব্যাপকতা বাড়ে। পরে ২৫তম ব্যাচে প্রশ্নফাঁস বিষয়টি ধরা পড়ে। গাড়ি চালকের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ থাকতো। তারা কাস্টমার যোগাড় করে দেয়ার দায়িত্বে ছিল। তার হাত ধরে অনেকেই হয়েছেন বিসিএস ক্যাডার। সব ক্যাডারেই রয়েছেন তার লোক। আবেদ আলীর হাত ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে একটি সংস্থা। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে তিনজন বিসিএস ক্যাডারের নাম প্রকাশ করেছেন গ্রেপ্তারকৃত একজন ডেসপাস রাইটার। এছাড়াও সম্প্রতি আলোড়ন তুলেছে দুর্নীতির দায়ে ওএসডি হওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের সম্পত্তির তথ্যও। মেগা-দুর্নীতির এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদও। এর ব্যাপক বিস্তার ও অনুশীলন সমাজকে বৈষম্যের মুখোমুখি করে সামাজিক ভাঙন সৃষ্টি করে। ফলত সামজিক আন্দোলন সূচিত হয়ে অশান্তি তৈরী হয়। যেটা এই মুহূর্তে আমাদের সমাজে ব্যাপক অশান্তির তরঙ্গ তৈরি করে মানুষকে হতাশায় ভাবিয়ে তুলেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি ছবি পোস্ট করেছে। ছবিতে একজন বাবাকে শিশুদের মতো হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সাথে লেখা, আপনার বাবাকে ‘টিকা’ দিন। বাস্তবে, এই টিকা কোনো রোগ প্রতিরোধের জন্য নয়, বরং দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি বার্তা দেয়া হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে আওয়াজ উঠুক ঘর থেকে; বাবাকে টিকা দিন, দরকার হলে নিজেও নিন।’ বাংলাদেশে চোরের খনি এটা কোনো নতুন কথা নয়। সাবেক একজন মন্ত্রীর মতে, ঢাকায় একটি বাড়িও বৈধ নয়। পেশাদারী চোরের উপর পেশাদারী বাটপারী করা নতুন কিছু নয়। কুমিল্লার এক অফিসের একজন পেশকার ক’বছর আগে একটি উক্তি করেছিলেন। তিনি এক মামলায় হাজিরা দিতে এলে ঘুষের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, ‘বস এত খায় আর আমি সামান্য খেলে দোষের কি দেখলেন?’ তার মন্তব্যটি শুনে সেদিন সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পরদিন এটি সংবাদের শিরোনাম হলেও পরে এনিয়ে আর কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। ‘ফাঁসকরা প্রশ্ন বিক্রির টাকা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছি।’ এসব কী কথা? এটা কি আমাদের সামাজিক শিক্ষা? আসলে ভোট চুরি, মেগা অপরাধীদের দলীয় প্রশ্রয়, মাদক সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতাদান ইত্যাদি দেখে সাধারণ মানুষ নিজেরা দুর্নীতি করতে ভয় পাচ্ছে না। এটাই আমাদের দেশের ব্যতিক্রমী সামাজিক শিক্ষা হয়ে উঠেছে। দেশে ৪০ ভাগেরও বেশি শিক্ষিত বেকারত্ব, চাকরির বাজারে আকাল, ঘুষ ছাড়া নিয়োগ নেই, ইত্যাদির কথা কে কাকে শোনাবে আর কে শুনবে?

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত