মাতৃবন্দনার অনন্য নিদর্শন ‘আমার সোনার বাংলা’

মো. তাহমিদ রহমান, লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশের একটি নির্দিষ্ট জাতীয় সংগীত রয়েছে। জাতীয় সংগীতে প্রতিফলিত হয় সেই জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ। পৃথিবীর বহুদেশে জাতীয় সংগীত রচিত হয়েছে রাজা-রাজন্যবর্গ, শাসকের মহত্ত্ব বর্ণনা করে।

অনেক ক্ষেত্রে রচিত হয়েছে যুদ্ধজয় কিংবা আধিপত্যের শৌর্যবির্যের জয়গান গেয়ে। বিশ্বের কিছু স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পরও পরবর্তী দুই বছর ব্রিটিশ জাতীয় সংগীতকে তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করে। কী করুন দীনতা! পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

উল্লেখ্য যে, গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন ১৯৩৮ সালে। মিশর তাদের জাতীয় সংগীতে একাধিক বার পরিবর্তন এনেছে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের কারণে।

জাপান জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছে প্রাচীন একটি কবিতাকে যা ৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বারবার সম্প্রসারিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন হাঙ্গেরির জাতীয় সংগীত হিসেবে যে গানটি গৃহীত হয় তার রচনাকাল ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দ। ফ্রান্স ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে যে কবিতাটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে তার রচনাকাল ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দ। ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত একটি গানকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা প্রদান করে ইংল্যান্ড। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আমাদের জাতীয় সংগীত।

সারা পৃথিবীর আজন্ম বিস্ময় আমাদের জাতীয় সংগীত রচিত হয়েছে এই বাংলারই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে। জন্মভূমি মাতৃস্বরূপ তাই এই মাতৃভূমির প্রকৃতির সুধাকে রসদ করেই রচিত হয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীত। ষড়ঋতুর বাংলাদেশের সোনালী ধানের অপূর্ব শোভা, বাতাসে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা পাখির কলকাকলি, নদীর কলতান, সুরেলা বাঁশির সুর এবং এদেশের সহজ সরল স্বপ্নচারী মানুষের হৃদয়াবেগে রচিত গানটিই আমাদের জাতীয় সংগীত। গানটি মূলত রচনা করাই হয়েছিল দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকে।

সেই সঙ্গে গানটি আমাদের গৌরবময় স্বাধীন সংগ্রামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যখন উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছিল, ঠিক তখনই ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং জন্ম হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের। অবিভক্ত পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল এবং নজরুল গীতিতেও সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল।

তথাকথিত হিন্দুয়ানী শব্দ বাদ দিতে নজরুল গীতিকেও অনেক ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল।

এমনকি আরবি-ফারসি-উর্দু হরফে বাংলা লেখার অকল্পনীয় ধৃষ্টতামূলক প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। সম্প্রতি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ঠিক তেমনি একটি প্রস্তাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সয়লাব হয়ে উঠেছে।

এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেকের ধারণা গানটি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত; কিন্তু এর স্বপক্ষে অকাট্য কোনো দলিল নেই। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতে প্রথম বঙ্গ ভঙ্গ হয় এবং এর প্রেক্ষিতে বঙ্গ ভঙ্গের বিরোধিতা করে কলকাতা টাউন হলে গানটি প্রথমবার গাওয়া হয়।

পরবর্তীতে বঙ্গ ভঙ্গ রদও হয়; কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় গানটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আমার সোনার বাংলা গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে। এরপর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত কন্ঠে গাওয়া হয় গানটি পরবর্তীতে ৩মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে ঘোষণা আসে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গ্রহণের।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রহ পরিষদের সভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে আমার সোনার বাংলা গাওয়া হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাককালে এই গানটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার এক মহামন্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমে উদ্বেলিত করতে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে গানটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও এদেশের কোটি দেশপ্রেমিক জনতার প্রাণে এখনও শিহরণ জাগায়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি সর্বসম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার সোনার বাংলা গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা প্রদান করা হয়। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে গানটি রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো কল্পনাও করেননি তার রচিত গানটি কোনো একসময় এই উপমহাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোনো একটি দেশের জাতীয় সংগীত হয়ে যাবে। গানটিতে দেশমাতৃকার প্রতি যে মমত্ববোধ ও ভালবাসা ফুটে উঠেছে তা সমসাময়িক কালে তো নয়ই স্বাধীনতা পরবর্তী অর্ধশতক বছর পরেও অন্য কোনো বাংলা ধ্রুপদী গানে ফুটে উঠেনি। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত একটি নিষ্পত্তি গত বিষয় হওয়ার পরও কিছু কুচক্রী মহল এটা নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারা করছে। এরা সুযোগ পেলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়েও প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে শিব নারায়ণ দাসের নামেও ধোঁয়া তুলে জাতীয় পতাকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে।

আমাদের বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত রূপ বিবর্তিত হয়ে ভারতীয় গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। আমাদের বাংলা বর্ণমালার মূল রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমনো দিন দেখতে হতে পারে যে কূপমন্ডুকের দল হতাশার নির্ঘুম রাত পার করে এগুলোরও পরিবর্তন চেয়ে বসে আছে। জাতীয় সংগীত নিয়ে আরো একটি অপবাদ প্রায়ই শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল গায়ক গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে...’ গানটিকে আশ্রয় করে আমার সোনার বাংলা গানটি রচনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলার মাটিতে অযত্নে লালিত এই বাউল সংগীতটিকে অমরত্ব এনে দিয়েছেন আমার সোনার বাংলা গানটি রচনার মধ্য দিয়ে।

দীর্ঘ আওয়ামী অপশাসনের পর এদেশের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে আপামর জনতা যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছে। দায়িত্ব গ্রহণকারী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন বিগত দিনের দুর্নীতি, অর্থনীতি, জনপ্রশাসন, পুলিশ ব্যবস্থাপনা, লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারসহ নানাবিধ কাজে গলদঘর্ম ঠিক, তখনি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে নির্ধারিত জাতীয় সংগীতের মতো মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা অপাঙেয় অপরিণামদর্শী উক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ রাজনৈতিক পরিবারের ব্যক্তিবর্গের কথা বলতে বা বক্তব্য দিতে বাক্য চয়নে সচেতন হওয়া উচিত। তাদের মাথায় রাখা উচিত আওয়ামী লীগ বিভিন্ন স্থাপনায় নাম পরিবর্তনের যে সংস্কৃতি চালু করেছিল আখেরে তার ফল ভাল হয়নি। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি অপশাসনে সাধারণ জনগন তিক্ত হয়ে গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে যেভাবে বিদায় করেছে- সেখানে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার মতো আবেগের জায়গাগুলোতে কেউ আঘাত করলে সচেতন তরুণ প্রজন্ম নরীব থাকবে, এটা প্রত্যাশা করা চরম বালখিল্যতা। বাঙালি তথা বাংলাদেশের প্রাণ সঞ্জীবনী গানগুলোর উপর বিশেষ মহলের কুঠারাঘাত নতুন কিছু নয়। রাজনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি বারবার আঘাত পেয়েছে; কিন্তু কোনো অশুভ শক্তির কাছে বাঙালি জাতি কখনো মাথা নত করেনি। যে গানের সঙ্গে বাঙালির প্রাণের আবেগ ও আত্মার সম্পর্ক তাতে কুঠারাঘাত আসলে এদেশের সচেতন নবপ্রজন্ম সমুচিত জবাব দিতে সদাজাগ্রত।