ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি

কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি

যা ভাবে কিংবা যা দেখে সেটুকুর সবটুকু কোনো ধরনের ভয়ভীতিহীন সংস্কৃতিতে লিখতে পারার অধিকারকেই লেখক/চিন্তকের স্বাধীনতা বলা চলে। অথচ এই অল্পদিন আগেও শব্দ চয়নেও অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হতো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাত্রই মাসকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। বিভিন্ন পেশাজীবীদের হরেক রকমের দাবি-ধাওয়া উপস্থাপিত হচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বঞ্চিত জনতা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে মনের পুঞ্জীভূত দুঃখ-ব্যথা জনগণের সরকারকে জানাতে চাচ্ছে ও যাচ্ছে। তাদের অধিকার ও দাবি অযৌক্তি বলার সাধ্য নাই তবে সময় ও পদ্ধতিকে যৌক্তিক বলারও উপায় নেই। সবাই খুব বেশি তাড়াহুড়া করছে অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথপূর্বক সংস্কারের প্রাথমিক ধাপে কেবল পদার্পণ করেছে। তাদের কিছুদিন সময় দিলে বোধহয় রাজপথে দাবি আদায়ের জন্য নামতে হবে না। বরং তারাই জনবান্ধব চাওয়া অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করে দেবে।

আমার সোনার বাংলাদেশ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশার অন্ত নেই। অতীব দুঃখের হলেও সত্য, বিগত ৫৩ বছরের শাসনামলে শাসকশ্রেণি যে জঞ্জাল রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রেখে গেছে তা ৫৩ দিনে দূর করা সম্ভব নয়। জন-আকাঙ্ক্ষিত সরকারকে যৌক্তিক সময় প্রদানের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রকে মেরামত করিয়ে নিতে হবে। নৈরাশ্যবাদী নই তবে অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তারা যাতে আর পূর্বের রীতিপথে, লুটপাট-দুর্নীতিতে, গুম-খুন, আয়নাঘরে, বাকস্বাধীনতা হরণে আবারো মেতে উঠতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার, সংবিধানের পরিবর্তন এবং প্রচলিত কুণ্ডনীতির বিলোপ নীতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বারাই ঠিক করিয়ে নিতে হবে। নয়তো যে উদ্দেশ্যে হাজার ছাত্র-জনতার জীবন রাজপথে বিলীন হয়েছে, যাদের অঙ্গহানী হয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে কিংবা যারা আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় গোঁঙাচ্ছে তার ত্যাগ-পরিণতি বিফলে যাবে। এমনকি এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বিফল হলে, বর্তমান সরকার তাদের প্রস্তাবিত সংস্কার আনতে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার হরিলুট উদযাপনের সুযোগ পাবে। তখন তাদের লাগাম টেনে ধরার মতো দ্বিতীয় কোনো কর্তৃপক্ষ থাকবে না। তখন আবারো সরকার স্বৈরাচার হয়ে উঠবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাতে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা রেখে যাচ্ছি। প্রথমত, শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। পতিত সরকার উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিগত এক যুগে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ করেছে। কারিকুলাম নিয়ে নয়-ছয়, প্রশ্নফাঁস, নকল, শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য পাসের হারের উল্লম্ফন ঘটানো, শিক্ষার্থীর সামনে জাতিসত্ত্বার, মুক্তিযুদ্ধের এবং তৎপরবর্তী সময়ের প্রকৃত ইতিহাস তুলে না ধরা, শিক্ষায় ধর্মের অবমাননার রসদ রাখা, নৈতিকতা চর্চায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব না দেয়া, দলীয় ঘরানার কবি-সাহিত্যিকদের গল্প-কবিতা সিলেবাসভুক্ত করা এবং মহৎ কবিতাণ্ডসাহিত্য সিলেবাসে না রাখার মতো গর্হিত কাজের দ্বারা শিক্ষার্থীদের ম্যোরাল ভিত্তি নড়বড়ে করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের পদে পদে হেনস্তা করা, নির্বাচনকালীন অপকর্মে শিক্ষকদের জড়িত থাকতে বাধ্য করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের অপতৎপরতায় শিক্ষার পরিবেশ বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের স্বাভাবিক পদলি-পদায়ন, পদোন্নতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো কোনো শিক্ষক কর্মকালের সবটুকু রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরের পদায়িত থাকবেন আর কেউ কেউ সব সময় মফস্বলে কিংবা দুর্গম চরাঞ্চলে থাকতে বাধ্য হবেন- এমন বৈষম্য যেন নতুন বাংলাদেশে বিরাজমান না থাকে। শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবনমান নিশ্চিত করতে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন কিংবা নতুন পে-স্কেল প্রণয়ন করে বাজার দরের সাথে আয়কে সামঞ্জস্য করার আশু পদক্ষেপ জরুরি। দ্বিতীয়ত, একটি জাতির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য স্বাস্থ্য খাতের সুস্থতা বড্ড প্রয়োজন। অথচ বিগত দিনগুলোতে স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসা সম্পর্কিত যন্ত্রপাতির টেন্ডার ও কেনাকাটায় হরিলুট চলেছে।

ডাক্তার অনুপাতে রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে ডাক্তারাও চিকিৎসা দিতে দিতে হাঁপিয়ে যান আবার রোগীও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করে। সেজন্য ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনী সংখ্যক চিকিৎসককে পদায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে যাতে সুচিকিৎসা কেবল রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক না থাকে। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল কর্তৃক যাতে রোগীকে জিম্মি করা না হয় সে ব্যপারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, যদিও দুর্নীতিকে তিন নম্বরের স্থান দিয়েছি তবে দুর্নীতিবিষয়ক আলোচনা সবার শুরুতেই রাখতে হবে। দুর্নীতি তথা ঘুষ, চাঁদাবাজি স্বজনপ্রীতি, লুটপাট কিংবা অর্থপাচার বন্ধ করা না গেলে দেশের মেরুদণ্ড শক্ত হবে না। দুর্নীতি বন্ধে সংবিধানের ন্যায়পাল প্রথা কার্যকর করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা না দিলে, দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর না হলে বাকি সব আয়োজন ব্যর্থ হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত