ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিচার নিশ্চিত করতে হবে

পিলখানা হত্যাকাণ্ড
বিচার নিশ্চিত করতে হবে

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার পালানোয় পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে। এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্বজনরা এবং নাগরিক সমাজ এরই মধ্যে ঘটনার পুনঃতদন্ত এবং সঠিক বিচারের দাবি তুলেছেন। তাদের মতে, এ ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং সঠিক বিচার হয়নি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত এবং সঠিক বিচার প্রয়োজন।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এদেশে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরতম এই হত্যাকাণ্ড। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হয় অকল্পনীয় এবং ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য এই হত্যাকাণ্ড। কিছু বিডিআর জোয়ানদের বর্বর আক্রমণে পুরো বিডিআর সদর দপ্তর একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। তাদের নৃশংশতায় তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা প্রাণ হারায়। অনেক সেনা কর্মকর্তার পরিবারসহ সেদিন মোট ৭৪ জন মানুষ মারা যায়। একটি দেশের আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের হাতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীর এতগুলো অফিসারের প্রাণহানির ঘটনা বিশ্বে এটাই প্রথম। একদিনে একসঙ্গে এতগুলো সেনাকর্মকর্তার প্রাণহানি কোনো যুদ্ধেও ঘটেনি। এমনকি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এতগুলো সেনা অফিসার প্রাণ হারায়নি। ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল মোট ৫৫ জন সেনাকর্মকর্তা। আর স্বাধীন দেশের মাটিতে দেশ বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রে একদিনে জীবন দেয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা। সেদিন জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েছে। সেদিনের ঘটনায় সেনাবাহিনী, বিডিআর এবং দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কখনো পূরণ হবার নয়। সেদিন যারা জীবন দিয়েছে, তাদের প্রতি গোটা জাতি শ্রদ্ধায় অবনত। এই বীর সন্তানদের এই দেশ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

দীর্ঘদিন থেকে এই পরিকল্পনা চলেছে এবং অনেকগুলো পক্ষ একসাথে জড়িত হয়ে এটি বাস্তবায়িত করেছে। কিন্তু মূল কারিগররা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। কারো একক উদ্যোগে সেনাবাহিনীর এতগুলো কর্মকর্তাকে হত্যা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সেনাবাহিনী এবং বিডিআরসহ দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে যারা দুর্বল করতে চায় তারা এক্ষেত্রে একজোট বেঁধেছে। ভারতকে করিডোরের নামে ট্রানজিট প্রদানের বিরোধিতা করায় একটি গোষ্ঠী দেশের সেনাবাহিনীর ওপর বেশ অসন্তুষ্ট ছিল। এজন্য সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বরাবরই ভারতকে করিডোর দেয়ার বিরোধী ছিলেন এবং এ বিষয়ে তিনি একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন।

পিলখানার সেদিনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপে ভুল ছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার একটু পরেই বিডিআরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের ওপর বিডিআর জোয়ানদের নেতৃত্বে হামলা শুরু হয় এবং খবরটি তখনই সরকারের কাছে পৌঁছে যায়। সরকার যদি সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীকে পাঠাত এবং পিলখানার চারপাশ ঘিরে ফেলে অভিযান চালাত তাহলে এতগুলো প্রণনহানি হতো না। সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করলে বিদ্রোহীরা হয় আত্মসমর্পণ করত, না হয় পালিয়ে যেত। সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনে বেশিক্ষণ যুদ্ধ করার ক্ষমতা এবং অস্ত্র কোনোটাই বিদ্রোহীদের ছিল না। আর বিমানবাহিনী যদি আকাশ থেকে গোলা নিক্ষেপ করত তাহলে সহজেই বিদ্রোহীরা নাস্তানাবুদ হতো। পুলিশ বাহিনী এবং র‌্যাব এসব কাজে সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে সাহায্য করত। ফলে অল্প সময়ে পরিস্থিতিকে সামাল দেয়া যেত এবং এ ক্ষেত্রে প্রাণহানি কম হতো। ঘটনার শুরুতে নিশ্চয়ই এতগুলো সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়নি এবং সেটা সম্ভবও নয়। ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা, তাদের লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়া, গণকবর খনন করে লাশগুলো পুঁতে ফেলে তা ভরাট করা এবং কিছু লাশকে পুড়িয়ে ফেলা অল্প সময়ের কাজ নয়। এতে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন হয়েছে।

সেনাবাহিনী সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে গেলে এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চিতভাবেই রোধ করা যেত। কিন্তু সরকার তা করেনি। ফলে হামলাকারীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পেয়েছে এবং সেই সময়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুরোপুরি সফল হয়েছে। কোনো ধরনের পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ করে এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়নি এবং আগে থেকেই এর পরিকল্পনা চলেছে। অথচ সিআইডি, এনএসআই, ডিজিএফআই এমনকি বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাসহ কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই এই ঘটনার খবর আগে জানতে পারেনি। যদি তারা সত্যি সত্যিই ব্যর্থ হয়ে থাকে তাহলে দায়িত্ব অবহেলা, অদক্ষতা এবং ব্যর্থতার জন্য এদেরও বিচারের মুখোমুখী করা দরকার ছিল। অবশ্য গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হলে, তারাও এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে বলেই ধরে নিতে হবে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার এই কারণও তদন্ত করতে হবে।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এই বিষয়ে কেউ মন খুলে কথা বলতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিহত সেনা পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআর পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত এবং সঠিক বিচার দাবি করেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষরাও এই ঘটনার পুনঃতদন্ত এবং সঠিক বিচার দাবি করেছে। এ অবস্থায় অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, উচ্চ পদস্থ সেনাকর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিনিয়র কূটনীতিক এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সিনিয়র সিটিজেনের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। এই কমিশন নিরপেক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং যে কোনো ব্যক্তি, যার কাছে এ ঘটনার তথ্য প্রমাণ রয়েছে তিনি নির্ভয়ে এই কমিশনের কাছে তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে জমা দেবে। এই কমিশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করবে এবং প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করবে। তারপর বিচার বিভাগ এই তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বিচার প্রক্রিয়াটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে কি না তা পর্যালোচনা করে প্রকৃত দোষীদের সঠিক শাস্তি দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত