ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হাসিনা-মোদির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

হাসিনা-মোদির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনে ভারত যে অত্যন্ত হতাশ, মর্মাহত এবং শোকে কাতর, তা বাংলাদেশের প্রতি তার আচার-আচরণে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন হয়নি, ভারতের পতন হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপুল সমর্থনের মধ্য দিয়ে গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যাতে কোনোভাবে স্থির, কার্যকর ও সফল হতে না পারে, ব্যর্থ হয়, এজন্য শুরু থেকেই মোদি এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনা মিলে নানা ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করে চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রতিবিপ্লব, গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা, জুডিশিয়ারি ক্যু, সচিবালয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের দিয়ে আন্দোলন, ভারতের ডম্বু বাঁধ খুলে দিয়ে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি, শাহবাগে বিভিন্ন দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায়কে দিয়ে বিক্ষোভ, ১৫ আগস্ট ঢাকায় লাখ লাখ লোক জড়ো করা, ২১ আগস্ট একই ধরনের অপচেষ্টা, তার তিন-চার দিন পর আনসারদের আন্দোলন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের দিয়ে আন্দোলন, গত শুক্রবার সনাতন অধিকার মঞ্চের ব্যানারে পুনরায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা বন্ধ ও জড়িতদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন এবং ৫ অক্টোবর লংমার্চ করে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা, এসবই যে মোদি ও তার আশ্রয়ে থাকা পলাতক হাসিনার যৌথ প্রযোজনার ষড়যন্ত্র তা দেশের মানুষের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসী। অন্তর্বর্তী সরকার এসব ষড়যন্ত্র সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করে চলেছে। তাদের এ ষড়যন্ত্র কোনো কাজে আসেনি। সব ষড়যন্ত্র ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত বৃহস্পতিবার উত্তর প্রদেশের লক্ষ্মৌতে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের প্রথম যৌথ সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-হামাস সংঘাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা এবং ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণের পরামর্শ দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাসের যুদ্ধের সাথে বাংলাদেশের নাম জুড়ে দেয়ার অর্থই হচ্ছে, প্রচ্ছন্নভাবে বাংলাদেশকে হুমকি দেয়া। এটা যে মোদি-হাসিনার নতুন ষড়যন্ত্র, তা সহজেই বোঝা যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় গত শুক্রবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য ইঙ্গিতপূর্ণ এবং উসকানিমূলক।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তিনি নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার মতো এমন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, যাকে সারাবিশ্ব সম্মান ও শ্রদ্ধা করে, যার জনপ্রিয়তা অপরিসীম, বিশ্বজুড়ে যার সুনামণ্ডসুখ্যাতি, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। তিনি অশতিপর হলেও তার কণ্ঠস্বর, চলনবলন, আচরণ তরুণদের মতো। তিনি তরুণদের অনুপ্রেরণা এবং তাদের মনমানসিকতা ধারন করেন। তাকে কেবল ভারতেরই অপছন্দ। কারণ, তিনি দেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যে ভারতের অন্যায্য আচরণের কথা মুখের উপর বলে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেই প্যারিস থেকে ভারতের এনডিটিভি চ্যানেলের এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভারতকে স্পষ্ট করে বলে দেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তার সেভেন সিস্টার্সও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। ভারতের মুখের উপর এমন সাহসী বক্তব্য আর কখনো শোনা যায়নি। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েই তিনি সীমান্ত হত্যা নিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ভারতের অনাগ্রহে অচল হয়ে থাকা সার্ককে সচল করার গুরুত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন। এসব কথা ভারতের পছন্দ না হওয়ারই কথা। ড. ইউনূসের মতো সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য এমন একজনকে ভারতের অপছন্দ করা তার হীনমন্যতা এবং কূটনৈতিক অপরিপক্কতার পরিচায়ক। সে বাংলাদেশে তার সেবাদাসী শেখ হাসিনাকে হারিয়ে পাগলপারা হয়ে গেছে। এটা যে, মোদির জ্ঞানের পরিধির সীমাবদ্ধতা, তা বুঝতে বাকি থাকে না। তার আচরণের কারণে ভারত তার সব প্রতিবেশীকে হারিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সে একা হয়ে গেছে। বিষয়টি উপলব্ধি করে যে, প্রতিবেশীর সাথে সমতা ও সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে, সেদিকে তার মন নেই। এটা তার জন্য আত্মঘাতী। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা শুধু ভারতকে সন্তুষ্ট করে ক্ষমতায় থাকতে শেষ দিনও ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। কোটি কোটি টাকা গণভবন থেকে দেয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান বিশেষ করে সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে উদ্দেশ্য করে ছাত্র-জনতার উপর সেনাবাহিনীকে গুলি চালাতে বলেছিলেন। তিনি তাতে রাজি হননি। ওয়াকার-উজ-জামান দেশের মানুষের পাল্স বুঝে ন্যায়নিষ্ঠতা ও দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময় সেনাবাহিনীকে অনেকটা দলদাসে পরিণত করা হয়েছিল। সাধারণত ‘হোস্টাইল এনিমি’ হিসেবে ভারতকে বিবেচনা করেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোটিভেট করা হয়। কারণ, আমাদের যুদ্ধের আশঙ্কা ভারতের দিক থেকেই আছে। ভারত ছাড়া আমাদের চারপাশে আর কেউ নেই। ‘হোস্টাইল এনিমি’ কে বা কারা সে অনুযায়ী সারাবিশ্বের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোটিভেশন দেয়া হয়। শেখ হাসিনা ভারতের তাঁবেদারি করার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারতকে ‘হোস্টাইল এনিমি’র মোটিভেশন চেঞ্জ করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা যে হয়নি তার প্রমাণ মিলেছে, হাসিনার নির্দেশ অমান্য করে ছাত্র-জনতার উপর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের গুলি চালানোর অপারগতা প্রকাশ থেকে। তিনি দেশপ্রেমিক এবং গণমুখী ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে সেনাবাহিনীর বিচলিত কিংবা শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, সেনাবাহিনীর পেছনে রয়েছে, দেশের ১৮ কোটি মানুষ। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আবু সাইদের মতো কোটি কোটি আবু সাইদ এখন তৈরি আছে, যারা বুক পেতে বন্দুকের মুখে দাঁড়াতে পারে। ফলে বিজেপির ভারত বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং সেই বাস্তবতাও নেই। বরং রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য হিতে-বিপরীত হয়ে দেশের মানুষকে আরো ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট উপলব্ধি করে ভারতের উচিত সাবধান ও হুঁশিয়ার হয়ে যাওয়া। ভারতের সাথে আমাদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিই হচ্ছে, সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। এই নীতিই সবসময় অক্ষুণ্ণ ও অটুট থাকবে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত কোনো আক্রমণ এবং তা প্রতিহত করার আত্মরক্ষামূলক প্রস্তুতি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সবসময় থাকতে হবে। আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জামাদির মাধ্যমে জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সমুন্নত করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নসহ উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

ভারতের মানুষের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী যে মনোভাব গড়ে উঠেছে, তার জন্য ভারতের মোদির খবরদারি ও আধিপত্যবাদী আচরণই দায়ী। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে নানা ধরনের ‘মিথ’ সৃষ্টি করেছিল, তা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক ফুৎকারেই চুরমার হয়ে গেছে। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের এই মানসিকতা বুঝতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান এবং মর্যাদার সাথে দেখতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, তা তার সেবাদাসী শেখ হাসিনার সময়ের বাংলাদেশ নয় যে, তার কথায় উঠাবসা করবে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তির হাতে। তার এবং বাংলাদেশের জনগণের সাথে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সব দেশের সমর্থন রয়েছে। ভারত ছাড়া সব দেশের কাছেই বাংলাদেশ গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যে অর্থনীতিকে তলানিতে রেখে গেছে, তা পুনরুদ্ধারে নানামুখী প্রচেষ্টা চলছে। শেখ হাসিনার মতো কপট কৃচ্ছ্রতা নয়, উপদেষ্টা পরিষদের সবাই প্রকৃত কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করে চলেছেন। মিডিয়া সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বর্তা দিচ্ছেন না। এ মাসে জাতিসংঘের ৭৯তম যে সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশগ্রহণ করবেন। তার সফরসঙ্গী থাকবেন মাত্র সাতজন। অন্যদিকে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যখন বিদেশ ভ্রমণে বের হতেন, তার সফরসঙ্গী থাকত দেড় থেকে দুইশ’। সর্বশেষ চীন সফরেও ছিল দেড়শ’র বেশি। তার এই বিলাসী ভ্রমণে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। অন্তর্বর্তী এই সরকার যখন অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে দেশকে বিশ্বের কাছে প্রকৃত রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে সচেষ্ট, তখন পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও মোদি মিলে তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছে। সর্বশেষ চক্রান্ত হিসেবে ফের সামনে আনা হয়েছে হিন্দুদের সংখ্যালঘু কার্ড। অথচ হিন্দুদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে অনেক আগেই অন্তর্বর্তী সরকার আশ্বাস দিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে হিন্দু নেতৃবৃন্দকে বলে এসেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সমান অধিকারের নাগরিক। তারপরও হিন্দুদের পুনরায় একই দাবি তুলে আন্দোলন কেন? পর্যবেক্ষকদের মতে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নতুন করে আন্দোলন এবং রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য একইসূত্রে গাঁথা। অথচ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে হিন্দু মন্দিরে হামলা, জমিদখলসহ বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখন তো তারা এভাবে আন্দোলন, লংমার্চ, ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয়নি। কেন দেয়নি? এ প্রশ্নের উত্তর তাদের খুঁজতে হবে। ষড়যন্ত্রের পাতা ফাঁদে তাদের পা দেয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। পরিবর্তিত বাংলাদেশকে তাদের বুঝতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রাখতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত