ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশ পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট
দেশ পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ

মানুষ হলো সামাজিক জীব। এটা আমাদের সবারই জানা। ব্যক্তিমানুষের সব সার্থকতা সমাজকে কেন্দ্র করেই। সমাজে স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করেই মানুষের সম্পূর্ণতা। কিন্তু মানুষ দল বেঁধে বাস করলেই তা সমাজ হয় না। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করলে সেই জনগোষ্ঠীকে সমাজ বলে।

এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিমানুষের অন্যতম দায়বদ্ধতা। এক সমাজে ধনী, গরিব, সহায়-সম্বলহীন নানা রকম মানুষের বাস। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে নিয়েই সমাজ। সমাজে পিছিয়েপড়া মানুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াই হলো সমাজসেবা। কিন্তু কেমন আছেন পাশের বাড়ির মানুষটি? এমন প্রশ্ন করার মতো সময়ও আমাদের নেই। ক্রমেই আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। এতে সমাজে নেতিবাচকপ্রভাব পড়ছে। তাই আমাদের চিন্তার পরিবর্তন জরুরি। ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বিগত সরকারকে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ফলে তাদের দাবিদাওয়া কিংবা চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি পূরণ না হলে তার মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে কোনো সমস্যা কিংবা আপদে-বিপদে কোনো ব্যক্তি যদি সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের কাছে সরাসরি পৌঁছাতে না পারে কিংবা দেখা না পান, তাহলেও তার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই যে সমস্যাটি লক্ষ্য করা যায় সেটি হলো- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকারের আচরণ এবং ভূমিকা কিছুটা পরিবর্তন হয়। সরকারে আসার আগে যে ধরনের প্রতিশ্রুতি থাকে জনগণের সামনে, ঠিক সে ধরনের আচরণ এবং প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে।

এবার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সামগ্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল। তারা যে ধরনের চিন্তা ও প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন করেছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে এই অর্জন ধরে রাখা যাবে না। এ কারণে সরকারের কর্মকাণ্ডে আন্দোলনের সংগঠকদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা চালু করা গেলে দেশের বিভিন্ন সমস্যার বাস্তব চিত্র উঠে আসবে এবং সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত সময়েও সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই গণ-অভ্যুত্থান ছিল রাজনৈতিক দলের। এবারই প্রথম ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও নেতৃত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের হাতেই। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও ছিল সামনের কাতারে। সে কারণে এই অভ্যুত্থানের বাস্তবতা ভিন্ন। ছাত্ররা একটি পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। রাষ্ট্র সংস্কার করতে চেয়েছিল। এখন তারা সেই সুযোগ পেয়েছে। বিগত সময়ের সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রী-এমপি কিংবা উপদেষ্টাদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। সে কারণে অনেক অভাব-অভিযোগের বিষয়ে সাধারণ মানুষ কোনো সমাধান পায়নি। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা হয়েছে, এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পাশাপাশি সহ-উপদেষ্টা হিসেবে যদি শিক্ষার্থীদের রাখা হয়, তাহলে তারা জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে। কারণ তারাই এসব সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। এর ফলে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যাবে, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আগে থেকেই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হলে সেটি খুবই ন্যায্য এবং প্রাসঙ্গিক হবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে পুলিশের তৎপরতা না থাকায় বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। হাতে লাঠি, মুখে বাঁশি নিয়ে ইশারায় তারা সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধু তা-ই নয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে লুট হওয়া জিনিসপত্র ফেরত, বাজার মনিটরিং, রাত জেগে পাহারা দেয়ার মতো কাজে মগ্ন হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ দেয়ালে দেয়ালে লিখছেন নানা স্লোগান, আঁকছেন গ্রাফিতি। এসবের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষম্য নিরসন এবং আন্দোলনে শহীদদের স্মরণ করছেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তারা সহিংসতা, দুর্নীতি ও অপকর্মমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি মাতৃভূমি রক্ষার অঙ্গীকার করছেন। ভালো-মন্দ এবং চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সাথে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে এই সরকারকে। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সাধারণ জনগণের নিজস্ব কী উন্নয়ন হচ্ছে- সেই সমীকরণটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণের যে ধরনের প্রত্যাশা থাকে সেগুলোর শতভাগ বাস্তবায়ন কোনোভাবেই কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া কিংবা প্রত্যাশার কোনো সীমা নেই। এ কারণে কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটি যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের অনেকের মনেই সরকারবিরোধী একটি মানসিকতা গড়ে উঠতে শুরু করে। প্রায় সবারই জানা, অনেক সরকারি দপ্তরে কাজ করতে গেলে সাধারণ মানুষকে হয়রানি হতে হয়। যেমন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্য কোনো বিদ্যালয়ে শূন্যপদে বদলির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের আদেশ থাকা সত্ত্বেও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পেছনে বারবার ধরনা না দেয়া পর্যন্ত ওই বদলির কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হওয়া কঠিন।

একটি দেশে বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল কাজ আছে, যেগুলো এক ধরনের ফাইল ওয়ার্ক। এসব ফাইল ওয়ার্ক যথাসময়ে হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিশিয়ালদের পেছনে ধরনা দিতে হয়। কিন্তু এ ধরনের প্র্যাকটিসের ফলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অজান্তেই তাদের আশপাশের অধীনস্থরা অথবা ব্যক্তিগত সহকারীরা অর্থনৈতিক উৎকাচ বিনিময় করেন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব অফিস-আদালত রয়েছে সেসব জায়গায় যথার্থ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বজনপ্রীতি, তদবির বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়, যা কোনোভাবেই সুশাসনের জন্য ইতিবাচক নয়। তাই এসব বিষয়ে শুধু সরকার নয়, দেশে ১৮ কোটি মানুষের মনমানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আনতে পারলে কখনোই পরিপূর্ণ সংস্কার সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরের দায়িত্বশীলদের যেমন সংস্কার প্রয়োজন তেমনি যারা সেবা গ্রহণ করবে তাদের মনেও শতভাগ ইতিবাচক প্রবণতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে বেশ কিছু অফিস-আদালত রয়েছে যেখানে ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। আবার সেবাগ্রহীতারা যাতে তাদের কাজ সাধন হওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য করেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট অনেক অফিসিয়াল তাদের সেবা কার্যক্রমকে কিছুটা জটিল থেকে জটিলতর করেন। এমন অসংখ্য সেক্টর কিংবা অফিস রয়েছে, যেখানে তদবির ছাড়া একজন সাধারণ মানুষ তার ন্যায্য কাজটি পান না। বারবার তাদের সংশ্লিষ্ট অফিসিয়ালদের টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও সামরিক সরকাররা যা বিগত ৫৩ বছরেও করতে পারেনি, তা যদি আপনারা সত্যিই করতে পারেন তাহলে দেশবাসী নিঃসন্দেহে আপনাদের স্যালুট জানাবে।

দেশবাসীর বিশ্বাস, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তারা যদি তৃণমূল সব ক্ষেত্রে তাদের তীক্ষè দৃষ্টি দিতে পারেন, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব হবে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের সংস্কার আমরা সবাই চাই। দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা একটি সিস্টেমকে ভাঙতে দেশের সরকার এবং জনগণ উভয়েরই বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। আমাদের সমাজের দিকে তাকালে প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, যা অতি দুঃখের হলেও সত্য। আজকের আধুনিক বিশ্বের ছোঁয়া সত্ত্বেও আমরা সেকেলে সমাজব্যবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে পারিনি।

একটি সমাজে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব রকম মানুষের বাস। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, কিন্তু সমাজে যারা গরিব সহায়-সম্বলহীন তারা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে দুঃখ কষ্টের কঠিন জীবনকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। স্বার্থকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই। এতে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ঘিরে আত্মকেন্দ্রিকতার এক সংকীর্ণ গণ্ডি গড়ে ওঠে। প্রকৃত সুখ রয়েছে সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করে বাঁচার মধ্যে। একজন মানুষ সঠিক শিক্ষা গ্রহণ না করলে তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। সে কারণে আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। একটি কথা মনে রাখা ভালো, সমাজ নিয়ে ভাবনার বয়স লাগে না, প্রয়োজন চিন্তা ও মানসিকতা। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আসবে না। ভাবতে হবে চারপাশের মানুষ নিয়ে। পরিবর্তন ছাড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের সবার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধই পারে সমাজের রূপ বদলে দিতে।

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত