ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনৈতিক উত্তরণ হবে মোহাম্মদ মইজ্জুর জন্য চ্যালেঞ্জিং

অলোক আচার্য, লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
অর্থনৈতিক উত্তরণ হবে মোহাম্মদ মইজ্জুর জন্য চ্যালেঞ্জিং

দেশের অর্থনীতি নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণের অল্পদিনের মধ্যেই বেশ বিপদে পড়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মইজ্জু। চীনঘেঁষা হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রেসিডেন্ট মইজ্জু এ নিয়ে চাপেই রয়েছেন। অর্থনীতি যে ঘোর সংকটে রয়েছে। ব্লুমবার্গে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এমনিতেই বেশ অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ।

এর মধ্যেই সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের সরকারি বন্ড সুকুক বিক্রির ব্যাপক হার এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। মালদ্বীপের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, বিনিয়োগকারীদের সুকুক বিক্রির হার যদি শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মালদ্বীপকে দেউলিয়া হওয়ার পথে পরিচালিত করবে। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে মালদ্বীপে ডলারের বিপরীতে সুকুকের দাম ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ার পর দেশটির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই বন্ড বিক্রি করে দেয়ার ধুম শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মালদ্বীপের রিজার্ভের মজুত কমে যাওয়াই সুকুক বন্ডের মূল্যহ্রাসের প্রধান কারণ। গত ২৪ জুন মালদ্বীপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেখানে এক বছর আগেও দেশটির রিজার্ভ ছিল ৭০ কোটি ডলার, সেখানে বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে নেমেছে ৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। সংকট এখানেই শেষ নয়, কারণ যে অর্থ রয়েছে তার বড় অংশই ব্যয় হবে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ। এর মানে এই যে, মালদ্বীপের অর্থনীতি বেশ সংকটে রয়েছে। এখান থেকে উত্তরণে ঋণ দরকার। যদিও সেই ঋণ পরিশোধ করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য থাকাও জরুরি। কারণ সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে এখনো যে ঋণ রয়েছে সেখান থেকে ঋণ পরিশোধেই একটি বড় অংশ ব্যয় হবে। এইবার আসা যাক মালদ্বীপের বর্তমান অবস্থার একটু আগের অবস্থা। ক্ষমতায় আসার আগেই মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের মুখে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা যারা মালদ্বীপে অবস্থান করছিল তাদের ভারতে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে শোনা গিয়েছিল।

ক্ষমতায় এসেই তিনি তার কথার বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লাগেন। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতের সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়।

ভারত এবং মালদ্বীপ দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ার এবং সার্কের সদস্য রাষ্ট্র। মালদ্বীপের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত মালদ্বীপকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে এবং মালেতে আবাসিক মিশন খোলে। স্বাধীনতার পর থেকে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির সাথে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিল কয়েক দশক। সুতরাং বলা যায় এই দুই দেশের সম্পর্কে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও কোনো নেতাই ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। মালদ্বীপের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ নাশিদ ভারত মহাসাগরের বুকে মালদ্বীপ তার অনিন্দ্যসুন্দর সৈকত, কোরাল রিফ আর সামুদ্রিক প্রাণিবৈচিত্র্যের এবং ১২০০ প্রবাল দ্বীপ আর অ্যাটল নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাষ্ট্রে জন্যই পরিচিত। এমন একটা জায়গাতেও যে ভূরাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছায়া ফেলতে পারে তা চট করে কারও মাথাতেই আসবে না। ভূরাজনীতি ইদানীং গত দশকের চেয়েও আরও বেশি দুটি দেশের সম্পর্ক এতদিন বেশ ভালো ছিল। এখনো রয়েছে তবে সেখানে নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার পর তা থাকবে কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। তাই দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে ভারত ও চীন দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত বিশ্বের উঠতি পরাশক্তি এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে যাওয়া দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর এবং বিশ্বে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ায় উঠতি দুই পরাশক্তি হিসেবে ভারত ও চীনকে বিবেচনা করা হয়। এই কারণেই দেশ দুটির মধ্যে রয়েছে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। যে প্রতিযোগিতা অন্যান্য দেশেও প্রভাব বিস্তার করে।

শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের প্রায় একমাত্র খাত পর্যটন এবং প্রতি বছর যেসব বিদেশি পর্যটক মালদ্বীপে যান তাদের একটি বড় অংশই ভারতীয়। পর্যটন ফিরলেই এই দুই দেশের অর্থনীতি ফিরবে। শ্রীলঙ্কাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার পর্যটনের উপর নির্ভর করেই। কিন্তু গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষা দ্বীপ সফরকে নিয়ে মালদ্বীপের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি ও বিরূপ সমালোচনা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করে। ভারতীয়দের অনেকেই সামাজিক যোগামোধ্যমে মালদ্বীপকে বয়কটের ডাক দেন। এরপর থেকে পর্যটনে ভারতীয় কমতে থাকে। তবে সেই সম্পর্ক এখন কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ গত শুক্রবার দিল্লিতে ‘প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা’ নিয়ে আলোচনায় বসেন ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব গিরিধর আরামানে ও মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হিলমি। মুইজ্জুর জয়ের পর এটিই প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশের প্রথম বৈঠক। বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে দুদেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করা, দুদেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের আসা-যাওয়া এবং দক্ষতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত সহযোগিতাসহ দুদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত সফর করেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির। পরের মাসে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রথমবার দিল্লি সফরে যান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। ভূরাজনীতিতে এখন সম্ভবত কোনো দেশই পিছিয়ে নেই এবং সময়ের পালাক্রমে কোনো দেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেখানে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে পরাশক্তিগুলো। সেখানে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীরা ক্ষমতায় থাক এমনটাই আশা করে এবং সে অনুযায়ী চেষ্টাও করে। ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ্ আর বিরোধী শিবিরের প্রার্থী মোহামেদ মুইজ্জু। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দিয়ে যে জাহাজ চলাচলের রুট বা শিপিং লাইনগুলো আছে, তার মাঝামাঝি খুব স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে থাকা মালদ্বীপে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে ভারত ও চীন প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভারতকে বাদ দিয়ে এ অঞ্চলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। মূলত ব্যালান্স বা ভারসাম্য নীতিই এ থেকে পরিত্রাণের উপায়। কারণ ভারত এই মুহূর্তে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং ভারতের বাজারও পশ্চিমা বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং পশ্চিমা দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ক্ষেত্র হচ্ছে ভারত। সেই বাজার আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এই দুটি দেশই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোটের সাথে সরাসরি যুক্ত যেখানে আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পরাশক্তিগুলো যুক্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন মালডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা সোলিহ্। ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ শক্তিশালী করেছেন। গড়ে তোলেন হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। তার সময়ে ভারতের সঙ্গে তার দেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখন সম্ভবত মইজ্জু তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন। কারণ বাস্তবতা ভিন্ন। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সমিকরণ ঠিক রাখতে হলে এমন একটি নীতি গ্রহণ করতে হয় যেখানে দেশের উন্নয়ন ধরে রাখা সম্ভব হয়। মালদ্বীপের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা প্রেসিডেন্টের জন্য চ্যালেঞ্জ। সেইসাথে বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নও এগিয়ে নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত