ইসলামী দলগুলো কী ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে?

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। স্বৈরশাসক হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সারা দেশে নেমে আসে আনন্দের বন্যা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ও শিশু-কিশোর বেরিয়ে আসে রাজপথে। দেশে যেনো নেমে আসে নতুন এক বসন্ত। কোটি কোটি মানুষ আনন্দ হিল্লোলে নেচে ওঠে। দেশের সর্বত্রই তৈরি হয় নতুন স্বাধীনতার আবহ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। লেখাটা যখন লিখছি তখন স্বাধীনতার একমাস পূর্ণ হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, স্বাধীন আকাশে এখনো কালো মেঘের ঘনঘটা রয়ে গেছে। নতুন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে। দেশের সব সেক্টর এখনো ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়নি। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের আমলে বিরোধীদলগুলো তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি। তারা ভয়ানকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় মাঠে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব নেই। এমন বাস্তবতায় নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতার মসনদে আসীন হবে বলে সকলেই মনে করেন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ইসলামপন্থিরা। বাংলাদেশ ইসলামী দলের সংখ্যা ৫০টি। এ ৫০টি দলের মধ্যে নির্বাচনমুখী সবচেয়ে বড় ও গুছানো দল হলো জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনমুখী বাকি দলগুলো অগোছালো, এলোমেলো এবং অনেকটা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত। এ গ্রুপগুলো সাধারণত মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ও পরিচালিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের গরিব, এতিম এবং সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো কওমী মাদ্রাসাগুলোতে ঠাঁই পায়। এ বঞ্চিত মানুষগুলোকে আলেমগণ তাদের মাদ্রাসাতে ভর্তি করান। লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে অনেকটা ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে এখানে তাদের বড় হয়ে ওঠা। এ গ্রুপগুলোর সবাই দেওবন্দী ও কওমী ধারার আলেম হিসেবে পরিচিত। এ ধারাতে রয়েছে ১৪টি উপদল। প্রতিটি উপদলে একজন করে খ্যাতিমান আলেম আছেন যিনি দলের প্রধান নেতৃত্বে সমাসীন। এ ১৪টি উপদল হলো- ১. তাবলিগ জামাত (দেওবন্দপন্থি); ২. তাবলিগ জামাত (সাদ কান্দলভিপন্থি); ৩. ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই); ৪. জমিয়তে ইসলাম (ওয়াক্কাস); ৫. জমিয়তে ইসলাম (নূর হোসাইন কাসেমী); ৬. খেলাফত আন্দোলন; ৭. খেলাফত মজলিস; ৮. ইসলামী ঐক্যজোট (আজিজুল হক); ৯. ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনি); ১০. ইসলামী ঐক্যজোট (মেসবাহুর রহমান); ১১. ইসলামী ঐক্যজোট (ইজহারুল ইসলাম); ১২. নেজামে ইসলাম, ১৩. বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও ১৪. হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত ইসলামের আবার রয়েছে দুইটা গ্রুপ। (ক), হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ (মুহিব্বুল্লাহ বাবু নগরী) ও (খ). বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলাম (আনাস মাদানী)। এ ১৪টি উপদল নিজেদেরই শুধু খাঁটি ইসলামী দল মনে করে। অন্য কাউকে ইসলামী দল মনে করে না। এসব কারণে ইসলামপন্থিদের মধ্যে ব্যাপক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তবে ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর পরিবেশ কিছুটা পাল্টেছে। প্রায় সব ইসলামী দলের মধ্যে কিছুটা নমনীয় ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে একটি ঐকমত্য হচ্ছে বলে অনেকে আশাবাদ প্রকাশ করছে। ময়দানে যেহেতু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত সেহেতু মানুষ বিএনপির একটি বিকল্প শক্তি খুঁজে ফিরছে। ইসলামী দলগুলো মনে করছে যে, এই বিকল্প শক্তিটি হচ্ছে তারা। তাই তারা সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে আসার চেষ্টা করছে। এটা ইসলামপন্থি জনগণের জন্য একটি ইতিবাচক সংবাদ। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, তাদের জনসমর্থন বেড়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বেড়ে ডাবল হয়েছে। জামায়াত ব্যতীত অন্যান্য ইসলামী দলের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ, তারা ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসও খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমান বাস্তবতা হলো, আলেমরা আর্থ-সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে। এটি নতুন নয়, ব্রিটিশ আমলে আমাদের আলেম সমাজকে আর্থ-সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে আমরা দু’বার দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু আলেমদের সে অবস্থার কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। ফলে তাদের বড় একটি অংশ নিজেদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন দীর্ঘকাল। অবশ্য ২০২৪ এর স্বাধীনতা তাদেরকে নতুন এক স্বপ্ন এনে দিয়েছে। নতুন এক সন্ধিক্ষণের হাতছানি তাদের জাগিয়ে তুলেছে। বর্তমানে তাদের সামাজিক কার্যক্রম মোটামুটি দেশের জনগণের কাছে বেশ দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কওমী মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে মসজিদের ইমাম ও কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়া। জাগতিক ব্যাপারে উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা তাদের খুবই কম। এ কারণে এ বিষয়ে তাদের মানসিকতাও দুর্বল। তাদের মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য বড়ো কিছু করার সঙ্কল্প সৃষ্টি হয়নি। জাতীয় পর্যায়ে দেশের সেবা কার্যক্রমে তাদের অংশীদারিত্ব নেই বললেই চলে। আর আলিয়া মাদ্রাসায় যারা অধ্যয়ন করে তাদের উদ্দেশ্য বড়ো হলেও বর্তমান বাস্তবতা তাদের জন্য খুবই প্রতিকূল। তাদের গন্তব্য অনেক দূরের হলেও তারা বেশি দূর যেতে পারেনি। ব্রিটিশ আমলের মতো তারা আজও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। যদিও নিকট অতীতে তাদের মধ্যে অনেকে জাতীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে দেশের সেবায় নিয়োজিত ছিল বা এখনো আছে। কিন্তু বর্তমানে তাদের গন্তব্য স্কুল কিংবা মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শিক্ষক হওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। বিয়ের কাজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মধ্যেই তাদের গন্তব্য নির্দিষ্ট। বড় জোর তারা আলিয়া মাদ্রাসা ও কলেজের প্রভাষক হতে পারে। এটাই হলো শিক্ষার্থীদের বর্তমান বাস্তবতা। তাই উভয় মাদ্রাসাব্যবস্থা দুই ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। এ দুটো সমস্যাই আলেমদের যথার্থ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় ও সমস্যা। আলেম সমাজের আরেকটি সমস্যা হলো, তাদেরই মধ্য থেকে একটি ক্ষুদ্র অংশের ইসলামবিরোধী শক্তির পক্ষে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করা। এ শক্তিটি ক্ষুদ্র হলেও ইসলামবিরোধীদের কাছে এটি অনেক বড় হাতিয়ার। তারা তাদের দলীয় প্রচার প্রচারণায় আলেমদের এ ক্ষুদ্র শক্তিটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে বহুদিন ধরে। এ শ্রেণির আলেমরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আসছে যুগ যুগ ধরে।