মোবাইল ফোনের গোপন বিপদ

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা আজ প্রায় সাধারণ মানুষেরও ধরাছোঁয়ার মধ্যে। এ ধরনের প্রযুক্তিই মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে গতিময়তা, দূরকে করেছে নিকট, বিশাল পৃথিবী আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। জীবনের সব ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি আজ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই আজকের মোবাইল বা সেলুলার ফোন। বিদেশে এর ব্যাপক ব্যবহার অনেক আগেই শুরু হলেও বিশ্বায়নের বদৌলতে আমাদের দেশে আজ মোবাইল ফোনের বাড়বাড়ন্ত। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে, বেসরকারি স্তরে সাধারণ ঠেলা-রিকশা, অটো ড্রাইভার প্রায় সবার হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ ছোটদের হাতেও আজ মোবাইল শোভা পাচ্ছে। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সুফলের সঙ্গে কুফলও যে রয়েছে তা এক সময় ধরা দেয়। মোবাইল ফোনের কুফল প্রথম ধরা পড়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে জাপান-আমেরিকায়। জাপানের হাসপাতালগুলোতেই প্রথম সেলুলার বা মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মোবাইল পরিষেবা দানকারী কোম্পানিগুলো হাসপাতালগুলোতে মোবাইল ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকে।

বিদেশের হাসপাতালগুলোতে যে সমস্ত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে তা অত্যধিক দামি হলেও আজকাল আমাদের দেশের নার্সিংহোম বা বড় বড় হাসপাতালগুলোতে তা ব্যবহার হচ্ছে বা ভবিষ্যতে হবে। জাপানের চিকিৎসকরা লক্ষ্য করলেন, হাসপাতালের রোগীদের শিক্ষাদানে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোতে সেলুলার ফোনের প্রতিক্রিয়া। মোবাইল ফোন চলাকালে ডাক্তাররা দেখলেন, অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সিরিঞ্জ পাম্পগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ সিরিঞ্জ পাম্প দিয়ে তরল ওষুধ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিরায় প্রবেশ করানো হয়। সুইডেনের একটি হাসপাতালে একজন রোগীকে সিরিঞ্জ পাম্প দিয়ে ওষুধ দেয়ার সময় তা হঠাৎ থেমে যায়।

সিরিঞ্জ পাম্পে কোনো ধরনের অসুবিধা দেখা যায়নি বা রোগীরও তেমন ক্ষতি হয়নি, তথাপিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত করেন ব্যাপারটির। তদন্তে প্রকাশ পায়, সে সময় রোগীর কাছাকাছি কোনো স্থানে সেলুলার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার হয়েছিল। সেলুলার ফোনের তরঙ্গ সিরিঞ্জ পাম্পের স্বাভাবিক কার্যকরণে বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেখা যায়, দুজনের মধ্যে কথা বলার সময় সিরিঞ্জ পাম্পের কাছাকাছি আসতেই সিরিঞ্জ পাম্প থেকে সতর্কতামূলক এলার্ম আসতে শুরু করে এবং এরপরই পাম্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর আরো লক্ষ্যণীয় হলো হাসপাতাল বা বাড়ির বাইরে চলাফেরার সময় পেসমেকার ব্যবহারকারী রোগীরা সেলুলার ফোন ব্যবহারকারীর খুব কাছে আসতেই পেসমেকারের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। পেসমেকার প্রস্তুতকারী সংস্থা পেসমেকার ব্যবহারকারীদের সতর্কতা অবলম্বনের সুপারিশ করেছে। পেসমেকারের ১৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে সেলুলার ফোন ব্যবহার করতে বা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। সেলুলার ফোন শুধু ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোতেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, মস্তিষ্কে টিউমার বা ক্যান্সার সৃষ্টি করার খবরটি বিদেশে অনেক আগেই জানা হয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্যে ১৯৯৮ সালে একটি কমিটির ওপর দায়িত্ব দেয়। এ ধরনের বিষয়ের ফলাফল জানার জন্য আমাদের অবশ্যই আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

সাম্প্রতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোন ব্যবহারে চোখের মণির সন্নিকটের উত্তাপ (৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বৃদ্ধিতে চোখের ছানি বা ক্যাটারেক্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। দর্শন সমস্যা সম্পর্কে মোবাইলকে দায়ী করেছে বায়োইলেক্টোম্যাগনেটিক জার্নাল। আরো বেশি রোমাঞ্চকর তথ্য হাজির করেছেন মার্কিন গবেষক এবং মুম্বাইয়ের চিকিৎসকরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মোবাইল ফোন অত্যধিক ব্যবহারকারীদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দৈনিক চার ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহারকারীর শুক্রকীটের সংখ্যা যারা কখনো মোবাইল ব্যবহার করেননি তাদের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন মোবাইলের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র এর জন্য দায়ী। এনালস অব নিউরোজিতে প্রকাশিত এক গবেষষায় বলা হয়েছে নার্ভের রোগী, বিশেষ করে মৃগীরোগীদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তেই পারে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। সুইস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী মস্তিষ্কে টিউমার রয়েছে এরকম ৯০৫ জন বয়স্ক লোকই সেলুলার ফোন ব্যবহার করতেন এবং আরো জানা যায় মোট ২০০০ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছেন- এ ধরনের লোকদের ব্রেইন ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে, যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি এদের চেয়ে ৩.৭ গুণ এবং দ্বিগুণ সম্ভাবনা রয়েছে যেদিকে সাধারণত ফোন ধরা হয় সেই অংশে। এত সব কিছু জানার পরও দিনকে দিন মোবাইলের ব্যবহার বাড়ছে বৈ কমছে না। বর্তমানে চীন, বাংলাদেশ ও ভারতে মোবাইলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। মোবাইল উৎপাদনের হার প্রায় ৪০ শতাংশ করে প্রতি বছর বাড়ছে। বিশ্বে মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১.২৬ বিলিয়ন আর প্রতিদিন প্রায় ৪৬, ০০০ নতুন মোবাইল সংযোগ হচ্ছে। ব্রেন ক্যান্সারের জন্য দায়ী রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি রেডিয়েশন, লাখ লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে সামান্যই ছিল তা কিন্তু জীবদেহে প্রভাব ফেলতে পারেনি। গত একশ’ বছর ধরে বেতার সরঞ্জাম, রেডিও ওয়ারলেস, রেডার, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদির আবিষ্কার এবং প্রসারের ফলে প্রতিদিন এ বিকিরণের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়ারলেস ইন্টারনেট এন্টেনার পরিমাণ দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। ১১৪ মিলিয়ন আমেরিকাবাসী আজ সেলুলার ফোন ব্যবহার করছেন এবং প্রতিদিন প্রায় ৬৫,০০০ মোবাইল সেট বিক্রি হচ্ছে এক যুক্তরাষ্ট্রেই। ব্যাপকহারে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ আজ ব্রেন ক্যান্সারের কারণ। মাইক্রো তরঙ্গ শক্তি দেহকোষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং তাপ শক্তির বিকিরণ মস্তিষ্কের বহির্ভাগে সংকোচন প্রসারণ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে ব্রেনে প্রবেশ করে। মোবাইলের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ যত বেশি কানের সংলগ্ন হবে ব্রেন কোষ তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ছোটদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। শিশুদের বেড়ে ওঠা দেহে বিকাশমান স্নায়ুমণ্ডল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ বড়দের থেকে ছোটদের মাইক্রো তরঙ্গ শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অধিক হওয়ার দরুণ বড়দের থেকে ছ্টোদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিনগুণ। বিজ্ঞানীরা আজ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্যে অভিভাবকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।

ব্রিটেনের ন্যাশনাল রেডিওলজিক্যাল প্রোটেকশন বোর্ড, ছোটদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পক্ষে মত প্রকাশ করেছে। কেননা বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বড়দের থেকে ছোটদের বেশি ক্ষতি করে। স^াভাবিকভাবেই ছোটদের মাথার খুলি বড়দের থেকে কম পুরু হওয়ার জন্যে ওদের প্রতিরোধী ক্ষমতা কম হওয়ার কারনেই বিকাশমান মস্তিষ্ক কোষ বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ পায়। অনুমান করা হয়, ব্রেন-টিউমার সৃষ্টিতে ৩০-৪০ বছর সময়ের দরকার হয়। স্বাভাবিকভাবেই যারা অল্প বয়স থেকেই মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্ত, দীর্ঘজীবনের মধ্য বয়সে তাদের স্বাস্থ্যের নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই সময় থাকতেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অভিভাবকরা সতর্ক হোন, আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক, এদের সুরক্ষিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।