ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সড়ক অবরোধ করে দাবি আদায়

নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে
সড়ক অবরোধ করে দাবি আদায়

গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকা সাতরাস্তায় ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলনে’র ব্যানারে পলিটেনিক ইনস্টিটিউটের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী তাদের কথিত দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা অবরোধ করলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল ১১টা থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে দাবি আদায়ের নামে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্র-জনতার সফল আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের নামে কারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে? কারা এই চরম জনভোগান্তি সৃষ্টি করেছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থির, ব্যর্থ এবং অকার্যকর করে তোলার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখন সকলেরই জানা। এগুলো যে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া দোসরদের অপকর্ম, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বিগত এক মাস ধরে একের পর এক যেসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তমূলক আন্দোলন হয়েছে, তা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম ঠেকিয়েছে। ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে অন্তবর্তী সরকার যখন রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পদার্পণের রোডম্যাপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শহরের ব্যস্ততম সড়ক অবরোধ করে বিশৃঙ্খলা ও যানজট সৃষ্টি করে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলা হয়েছে। তথাকথিত কারিগরি ছাত্র আন্দোলন যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছে, তা হঠাৎ করে দেখা দেয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মতভিন্নতা রয়েছে। জাতির এই ক্রান্তিকালে এসব পুরোনো ইস্যু নিয়ে তাদের আন্দোলনে নামার পেছনে পতিত স্বৈরাচারের এজেন্টদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনীকে হন্তারক হিসেবে ব্যবহার করায় গণঅভ্যুত্থানের পর তা অকার্যকর ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত পুলিশের হাজার হাজার সদস্য কাজে যোগ না দেয়ায় তা পুরোপুরি সচল হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র সমাজকে রাস্তার ট্রাফিক কন্ট্রোলের মতো জরুরি দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দাবি-দাওয়া নিয়ে আনসার বাহিনীর সচিবালয় ঘেরাও করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দেয়ার ভয়ংকর ষড়যন্ত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকিয়েছে। সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন, ১৫ আগস্ট পতিত সরকারের দোসররা দশ লাখ লোক জড়ো করে সরকারকে ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রও তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্র সমাজ সফল হয়েছে। তবে সাতরাস্তায় কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের নামে ৬ ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধের মাধ্যমে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। এটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। অস্বীকার করা যাবে না, স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের অনিয়ম-দুর্নীতির জঞ্জাল এক মাসে নিরসন করা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই যারা নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তাদের কোনো খবর ছিল না। এখন যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, তখন তা নিয়ে তারা আন্দোলন করেনি। এতদিন এসব দাবি কোথায় ছিল? এসবই যে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসরদের ষড়যন্ত্র, তা বুঝতে বাকি থাকে না। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার এজেন্ডা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করে মেরুদ ভেঙে দেয়ায় তারা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের মধ্যে এখন জড়তা ও ভয় কাজ করছে। ফলে সাতরাস্তায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে শৈথিল্য কাজ করেছে। এতে নগরজুড়ে যে অসহনীয় যানজট ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। অনেক রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স যেমন আটকা পড়েছে, তেমনি অনেক বিদেশগামী যাত্রীর ফ্লাইট মিস হওয়ার পাশাপাশি কর্মস্থলগামীরা যথাসময়ে যেতে পারেনি। ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হয়ে পড়ে। এতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ করে যারা এই দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, তাদের নেপথ্যে দুষ্কৃতকারী থাকা অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে এ অপকর্ম করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্র এবং আনসারদের আন্দোলন সফলভাবে মোকাবিলা করার পর দাবি আদায়ের আন্দোলনের নামে যেসব গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে রাস্তায় নেমেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সেসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। তাদের যেন এদিকে মনোযোগ নেই। অথচ দাবিদাওয়ার নামে এসব চক্রান্তমূলক আন্দোলন থামাতে তাদের কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল। তারা যদি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করত, তাহলে এসব ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসররা লেজ গুটিয়ে পালাত। তা না করে, তারা এখন দেশব্যাপী মতবিনিময় করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে যদি দাবি-দাওয়া নিয়ে চক্রান্তকারি গোষ্ঠী একের পর এক আন্দোলন করতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। সমন্বয়কদের বুঝতে হবে, যারা তথাকথিত দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় আন্দোলনে নামছে, তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং ব্যর্থ করার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে। কাজেই, সমন্বয়কদের এসব ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন দমাতে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পতিত সরকারের দোসরদের চক্রান্ত অংকুরেই দমন করতে হবে। তা নাহলে, তাদের রক্তে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা ভেস্তে যাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদেরও এসব চক্রান্তমূলক আন্দোলন মোকাবিলায় মনোযোগী হতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করার মতো কাজ পরেও করা যাবে। বরং সরকারের অস্তিত্বে আঘাত হানার চক্রান্তমূলক আন্দোলন দমাতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তরুণদের বিপ্লবের মাধ্যমে শুধু দেশ নয়, নতুন পৃথিবী তৈরি হবে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীলনকশায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, মানবাধিকার, দুর্নীতি ও বৈষম্যবিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে দেশের ছাত্র সমাজ যখন জাতিকে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে, তখন ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের এজেন্টরা নানা ইস্যু নিয়ে গোলমাল পাকাতে চাইছে। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, সাতরাস্তায় কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের নামে অবরোধ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারিরা পতিত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রতিপালিত ও অনুগত। এতদিন এরা ছাত্রলীগের ব্যানারে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তার লাঠিয়াল হিসেবে চাঁদাবাজি- টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত ছিল। এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মনগড়া দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এসব দাবি নিয়ে এতদিন তারা কোনো আন্দোলন করেনি। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই নৈরাজ্য সৃষ্টির নেপথ্যের ক্রিমিনালদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে গণহত্যাকারী অপশক্তির এজেন্টদের অশুভ তৎপরতা চলতে দেয়া যায় না। নতুন নতুন দাবি নিয়ে আন্দোলনের নামে পতিত স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের রাস্তায় নেমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কঠোর অবস্থান নেয়ার বিকল্প নেই। সমন্বয়কদের দেশব্যাপী ঘুরে ঘুরে মতবিনিময়ে পুরো মনোযোগ দিলে হবে না। একের পর এক যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে এবং এর পেছনে যারা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে জনজীবনে স্বস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে শৈথিল্য বা খোশ মেজাজে থাকার কোনো সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত