বাংলায় কাওয়ালির উত্থান যেভাবে হলো

মাহমদু সালেহীন খান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

৯০ থেকে ৯৫ এ সময়ে আমি স্কুলে পড়ি। আমরা তখন থাকতাম নারায়ণগঞ্জ শহরে সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম ভাইয়ের বাসায়। তাদের পরিবার মাইজভান্ডারির মুরিদ। বছরে একবার জলসাঘর হতো। সেই জলসায় সারা রাত ভরে কাওয়ালি গান হতো। সেই সময় থেকে কাওয়ালির সাথে পরিচয়। তারপর ৯৮-এ ঢাকায় আসার পর থেকে আর কোনো কাওয়ালি আসরে বসা হয়নি। গত এক মাস কাওয়ালি সন্ধ্যা হচ্ছে বেশ বড় করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তিতুমির কলেজসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাওয়ালির আসর বসছে। তরুণ সমাজ সাদরে কাওয়ালি আসরকে গ্রহণ করেছে। হঠাৎ করেই কাওয়ালির জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে অনেকে ভাবতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংগীত চর্চায় কাওয়ালি একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে প্রাচীন যুগ থেকে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় কাওয়ালির জনপ্রিয়তা এক সময় ছিলো তুঙ্গে। কাওয়ালি দক্ষিণ এশিয়ায় উৎপত্তি হওয়া সুফি ইসলামী ভক্তিমূলক সঙ্গীতের একটি ধরন। এটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার সুফি মাজার বা দরগাহে পরিবেশিত হতো। ‘কওল’ শব্দটি থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। আবার অনেকের মতে, দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কাওয়াল নামক যাযাবর সম্প্রদায় কর্তৃক গীত সাধারণ ভক্তিমূলক গানকে কাওয়ালি বলে চিহ্নিত করা হয়। সুফি দর্শনে পরম সত্যের স্মরণ এবং তার মাধ্যমে বাহ্যিক অস্তিত্বকে নিজের সাধনার দিকে আরো মনোনিবিষ্ট করার জন্য সংগীত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রথমদিক থেকে সুফিদের সাধনার মধ্যে সামা নামের একটি অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। সাধারণত সন্ধ্যার পর সুফিদের খানকা শরিফে তাদের সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত বাণী (এই বাণীকে ‘কওল’ বলা হয়, এটি একটি আরবি শব্দ) বারবার উচ্চারণ করে, কখনো কখনো এর সঙ্গে ভাবে অবলুপ্ত হয়ে সুফিরা তাদের সাধনাকে মনোনিবিষ্ট করার জন্য এই অনুষ্ঠান করতেন। অনুষ্ঠানটি মধ্য ইরাকে, মিশরে, মরক্কোতে সুফিদের মধ্যে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল। এই ধারণাটিই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট স্থানীয় ভাবনা-চিন্তা, দর্শন এবং সঙ্গীতের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সামার ধারণাটিই ভারতবর্ষে এসে সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে, যা বর্তমানে কাওয়ালি নামে পরিচিত। ভারতবর্ষে কাওয়ালির জনক বলা হয় আমির খসরুকে। দিল্লির সুফি সাধক আমির খসরু, যিনি চিশতিয়া তরিকার একজন সাধু ছিলেন, ১৩শ’ শতকের শেষভাগে ভারতীয়, পার্সিয়ান, আরবি, তুর্কি এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে আজকের কাওয়ালি সঙ্গীত তৈরি করেন। আমির খুসরুই ভারতবর্ষের সুফিদের মধ্যে প্রচলিত প্রবণতাকে সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেছিলেন। ক্রমে তাকেই ভারতবর্ষে কাওয়ালির জনক বলে চিহ্নিত করা হয়। মধ্য এশিয়া ও তুরস্কে ‘সামা’ শব্দটি এখনো কাওয়ালির অনুরূপ সঙ্গীত ধরন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ভারতে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কাওয়ালি সেশনের আনুষ্ঠানিক নাম ‘মেহফিল-ই-সামা’। প্রথমদিকে, কাওয়ালিতে সংগীতযন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। কাওয়ালি শুধুমাত্র উর্দুতে গাওয়া হয় না। বরং মূলত ফার্সি, উর্দু, পাঞ্জাবি ভাষায় গাওয়া হয়ে থাকে। গাওয়া হয় আরবিতে, ব্রজ ভাষায়, আওধিতে। কাওয়ালি মূলত প্রেমের কথা বলে। সব রকমের প্রচলিত ধারণা, বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে প্রেমকে পাথেয় জেনে সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করা, সত্যের সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলার আকুতিই কাওয়ালির প্রধান বিষয়বস্তু। মোহাম্মদ নাদীম এহতেশাম রেজা খাঁ। তিনি নাদীম কাওয়াল নামেই ঢাকায় পরিচিত। বর্তমান ঢাকায় কাওয়ালি চর্চার প্রধানপুরুষ বলা যায় তাকে। বাংলাদেশে কাওয়াল সংগীতের প্রবেশ তার পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই। নাদীম কাওয়াল বাস করেন মিরপুর। কিন্তু চষে বেড়ান সারা দেশ। নেশা-পেশা বলতে যদি কিছু থাকে তা কেবল কাওয়ালি। কাওয়ালির ইতিহাস ও বাংলায় আবির্ভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে কথার ঝাঁপি খুলে বসলেন। আনন্দ আর উত্তেজনায় অনর্গল বলে গেলেন কাওয়ালি চর্চায় যুক্ত সাধকদের নাম। জানালেন ৫০০-৬০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় কাওয়ালি চর্চার গৌরবের কথা। তার পূর্বপুরুষদের লেখা কাওয়ালি শত বছর ধরে বিখ্যাত ব্যক্তিরা গেয়ে আসছেন। বাংলাদেশে কাওয়ালি সংগীতের ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় ‘৫০০-৬০০ বছর আগের ইরাকের নাজাফ থেকে নাদীম কাওয়ালের পূর্বপুরুষরা ভারতবর্ষে আসেন। তারা আজমীর শরিফে অবস্থান নেন। খাজা গরীবে নেয়াজের মাহফিলে কাওয়ালি পরিবেশন করতেন। সেখানে নাদীম কাওয়ালের বড় দাদা ২৯ বছর কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন। বাবা পরিবেশন করেন নয় বছর। পরদাদারাও ছিলেন একই দায়িত্বে। হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনি (রা.), হযরত শাহ পরাণ (রা.)-সহ অনেক সুফি-সাধক ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসতে শুরু করলে তাদের সঙ্গে কাওয়ালদেরও আগমন ঘটে। কাওয়ালরা ঢাকার নবাবদের বিশেষ মেহমান হিসেবে গুরুত্ব পেতেন। নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব হাবিবুল্লাহ- তখনকার নবাবরা সুফি-সাধকদের বায়াত গ্রহণ করেন। এভাবে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা দিল্লি ও ঢাকায় যাতায়াত করতেন। এখনো আহসান মঞ্জিলের সামনে ওয়াইজ ঘাটে আমার বড় দাদার মাজার শরিফ আছে।’ হযরত নাজমুল হাসান আবু ইলাহি নকশবন্দি ভারতের পাটনা মিতান ঘাট থেকে বাংলায় আসেন। তার সঙ্গে বেহের শরিফ থেকে নাজমুল হাসান আবু ইলাহির ওস্তাদ হযরত মাখদুম জাহান মখদুম শরফুদ্দীন আহমাদ সোনারগাঁ আসেন। সোনারগাঁয় তার মাজার শরিফ আছে। কাওয়ালির জনক আমীর খসরু লিখেছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে মোহে আপনেহি রং মে রং দে নিজাম...। এটি পরে নুসরাত ফতেহ আলী খান গেয়েছেন। আমীর খসরু সাহেবের বেশকিছু জনপ্রিয় গান আছে, যা নুসরাত ফতেহ আলী খানসহ অনেক জনপ্রিয় হিন্দি-উর্দু শিল্পী গেয়েছেন। দেশ ভাগের অল্প কিছু আগে আমীর রেজা খাঁ, দাদাজান ক্বায়াম রেজা খাঁ, বাবা এহতেশাম রেজা খাঁ পাকাপাকিভাবে ভারত থেকে বাংলায় চলে আসেন।