ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের ক্রান্তিলগ্নে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট
দেশের ক্রান্তিলগ্নে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মুহাম্মদ ইউনূস মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ পাস করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স-এ যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসাবে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।

১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেখান থেকে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। পরে ওই ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়ে ছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। কিন্তু নিজ দেশেই গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন কোণঠাসা। কর্তৃত্ব হারিয়ে ছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত সেই গ্রামীণ ব্যাংকের। নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাত্র ৬ মাসের মাথায় রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। শুরুর ইতিহাস থেকে জানা যায়, দারিদ্র্য বিমোচনের যুদ্ধে তার সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সঙ্গে যোগ দেয়। তিনি তখন অর্থনীতির প্রফেসর ছিলেন।

সে সময় ইউনিভার্সিটির পাশের দারিদ্র্যপীড়িত জোবরা গ্রামে গবেষণা প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পটি হাতে নেয়। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন ওই গ্রামে। একেবারে নিম্নস্তর থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনে ও পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দূরীকরণের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। নোবেল প্রাপ্তিতে হঠাৎ করে দেশ যেন জেগে উঠল। সারা দেশের মিডিয়াতে খবরের শিরোনাম ছিল গ্রামীণ ব্যাংক। প্রিন্ট মিডিয়ায় নিউজ হেডলাইন করতে দেখা গেছে বাংলাদেশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।

সারাদেশে অসংখ্য ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেল প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল, স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসেছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানাতে। সরকার দলীয় বিরোধীদলীয় মন্ত্রী এমপিরাও এসেছিলেন শুভেচ্ছা জানাতে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ছিল খবর সংগ্রহে সরব।

ধন্য বাংলাদেশ ধন্য প্রফেসর ইউনূস ধন্য গ্রামীণ ব্যাংক-সবার মুখে তাই ছিল। বিশ্ববাসী থেকে ক্রমান্বয়ে প্রশংসা এবং মুগ্ধতায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো ড. ইউনূসের সৈনিকরা কাজের মাধ্যমে ব্যাংককে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ করে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নরওয়ের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের পর থেকে প্রফেসর ইউনূসকে হেনস্তা করা শুরু হলো হাসিনার সরকার।

তখন অনেকেরই সন্দেহ হয় এ কাজটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করিয়েছে। কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করে পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি পর্যায়ে লোকজন প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করা শুরু করে।

সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ রকম বক্তব্যে ব্যাংকিং কার্যক্রমে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটেনি। প্রফেসর ইউনূসকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হলো। তাকে জোরপূর্বক ব্যাংক থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো। সরকারের বোঝা উচিত নোবেল পুরস্কার কোনো ব্যক্তির কৃপায় হয় না। যদি তাই হতো বিশ্বে কি ধনাঢ্য ব্যক্তির অভাব ছিল? যদি সেই সুযোগ থাকত আমাদের দেশে কমপক্ষে ৫০টি নোবেল পুরস্কার আসত। কিন্তু বাস্তবতা স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়? যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। দেশকে নতুন করে সম্মান এনে দিয়েছেন। হাসিনা সরকার তা মানতে নারাজ।

আমরা যে পুরস্কার প্রাপ্তির কারণে এক লাফে অনেক ওপরে উঠে গেছি, সেটাও তাদের অনুভূতিতে আঘাত করেনি, কী দুর্ভাগ্য আমাদের। নোবেলের বিষয়টি আমাদের কাছে নতুন ছিল না। প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের নোবেল পুরস্কারের প্রস্তাবনার বিষয়টি আমরা ১৯৯৪ সাল থেকে শুনে আসছি। এটা হঠাৎ করে হয়নি। এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে প্রফেসর ইউনূস তিনটি সেরা পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন : ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার।

সেটা কি অর্থের বিনিময়ে হয়েছে? আমেরিকার সেরা দুটি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেস গোল্ড মেডেল পুরস্কার। তাছাড়া জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, ইতালি, ফিলিপিনস দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছে। বিশ্বের ৬২টি দেশ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও পেয়েছেন।

তাছাড়াও বিশ্বের ১০৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সেন্টার চালু আছে। অনেক দেশেই ড. ইউনূসের মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। যারা নিমন্ত্রণ করেন তারা বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজির সুবক্তাও বটে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সরকার তা মূল্যায়ন করতে পারেনি। তিনি ভারতের লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। বছর দুই আগেও আসামের রাজ্যসভায় বক্তব্য রেখেছেন। বার্লিন দেয়াল ধ্বংসের ২০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জার্মানিতে যখন বক্তব্য রাখেন, তখন ইউরোপের সব সরকারপ্রধান মাথা নিছু করে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য টিকিট কেটে শুনছিলেন। তিনি সারা বিশ্বের সামাজিক ব্যবসারও উদ্যোক্তা। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন দেশে সম্মেলনও করে যচ্ছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন পছন্দ করেন। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের ব্যাংক; অযথা খরচ করতে কাউকে অনুমতি দেননি। তিনি যখন এমডি ছিলেন কাঠের চেয়ারে বসতেন এ ধারা ম্যানেজার থেকে শুরু করে সবার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চালু আছে।

ঋণ তদারকিতে সদস্যদের বাড়িতে গেলে পাটি বা চৌকি অথবা বেতের মোড়ায় বসতেন এবং এগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে অর্থ পাচারকারী সুদখোর, ঘুষখোর আর কত কি উপাধি দিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীও যাচ্ছেতাই মন্তব্য করলেন। এর প্রতিবাদে ফিল্ড পর্যায়ে মানববন্ধনও করা হয়েছে। সরকার কিছুই তোয়াক্কা না করে অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। এমনকি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করেছে। মনে হচ্ছে যেন শেখ হাসিনা নোবেল না পাওয়ায় এত যন্ত্রণা। উনি যেন নোবেল নিয়ে মারাত্মক দুর্গতিতে পড়ে গেলেন। যে দেশে গুণীজনের সম্মান নেই সে দেশে গুণীজন জন্মায় না।সেটা বুঝতে আমাদের এতটা সময় লাগল-সেটাই সবচেয়ে বড় আফসোস।

বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন বলে সব কৃতিত্ব তার। কিন্ত ক্ষুধামুক্ত বা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যার অবদান তিনি কি সম্মান পাওয়ার যোগ্য নন? এই প্রশ্ন জনগণের কাছেই ছিল। বিগত ১৫ বছর আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের কাজে লাগাতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই; কিন্তু সহযোগিতা না নিয়ে মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখলেন। এতে ক্ষতি কার হলো, অবশ্যই বাংলাদেশের। নরওয়েতে সম্প্রসারিত প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে জোরালো তদন্ত করা হলো অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি তা তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করলেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদ নেয় এটাও রিপোর্টে উল্লেখ ছিল। তাই তো গ্রামীণ ব্যাংক হাজারও প্রতিষ্ঠানের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান।

এ উপমহাদেশে রবিঠাকুর, মাদার তেরেসা অমর্ত্য সেন, প্রফেসর আবদুস ছালাম এবং আমাদের প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কারও চেয়ে কেউ কম নয়। তাই বলে নিজের দেশের নোবেল বিজয়ীকে বাদ দিয়ে অন্য দেশের নোবেল বিজয়ীকে দিয়ে একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে হবে? সেটাও আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সময়। এভাবে পদে পদে নোবেল বিজয়ীকে অপমানিত করে তিনি কি সম্মানিত হয়েছেন? মোটেও না বরং এই অপমান করার প্রতিফল স্বরূপ শেখ হাসিনা নিজেই অপমানিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের সময় অধ্যাপক সাইফুল মজিদকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কী কী অনিয়ম আছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে অডিট করালেন; কিন্তু কিছুই পাননি।

সত্যি বলতে কী, তিনি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে দেখা যায়নি। তাকে নিয়ে ব্যাংকে বহু সমালোচনা আছে। তিনি ব্যাংকের অনেক ফান্ড তসরুপ করেছেন। কিন্ত তার বিচার হয়নি।

গ্রামীণের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নাম গেঁথে আছে এবং তা থাকবে আজীবন। কেউ তার সম্মান কেড়ে নিতে পারবে না। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন ঋণ আমাদের মৌলিক অধিকার। প্রযুক্তির পিঠে সওয়ার করে দেশ একদিন এগিয়ে যাবে, তোমরা কিন্তু গরিব মানুষের শিক্ষক, মনে রেখ আমরাও পারি। সৃজনশীল কাজ করতে হলে ক্রমাগত ভাবতে হবে, আমরা এ মূল্যবান কথাগুলো ধারণ করে আছি এবং আজীবন থাকব।

আজ দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে একজন সৎ মানুষের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব অর্পণ করায় আমরা গর্বিত। ওনার হাতেই আমাদের দেশ সুরক্ষিত থাকবে, গতি হারাবে না প্রিয় মাতৃভূমি। আশা করি দেশবাসী সবাই মিলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সহযোগিতা করবেন এবং আমরা এও আশা করব, তিনি তার মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেশ ও জাতির শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রেখে দেশকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত