ইরান ইসরায়েলের যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসরায়েলের বুকে ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল। ইসরায়েল বরাবর এই ধরনের হামলার জুজু সারা বিশ্বকে দেখিয়ে এসেছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সুসম্পর্ক ছিল। ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আয়াতুল্লাহ খামেনি তেহরানের মসনদে বসার পর থেকে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হয়ে থাকে। পরবর্তী কালে দু’দেশের মধ্যে ছায়াযুদ্ধও শুরু হয়েছে। ইরানি মদতপুষ্ট লেবাননের হিজবুল্লা ও ইয়েমেনের হাউজি লাগাতার ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়ে এসেছে।

হামাসের পেছনেও ইরানের মদত সুবিদিত। লাগাতার ছায়াযুদ্ধ চলতে থাকলেও এত দিন দু’দেশের মধ্যে সরাসরি হামলার ঘটনা ঘটেনি। ইসরায়েলের বরাবরের আত্মকসহ তাদের দেশ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাভুক্ত, ইরানের হাতে যদি পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তা হলে যে কোনো মুহূর্তে তারা ইসরায়েলের বুকে বড়সড় কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত ইরান সেই ক্ষেপণাস্ত্র হানা ঘটাল। তবে এটা সম্পূর্ণ বলে-কয়ে। এক্ষেত্রে প্ররোচনা যে ইসরায়েলের পক্ষ থেকেই এসেছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ইরানের কনস্যুলেট ভবনের উপর আচমকা ইসরায়েলের ফাইটার জেট গিয়ে কেন হামলা চালাল, তার কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। ইরানকে পালটা হানার প্ররোচনা দিতেই যে এপ্রিল মাসের ১ তারিখে ইসরায়েল এই হামলা করেছিল, তা মনে করে মুসলিম বিশ্ব। ওই হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর শাখা ইসলামি রেভলিউশনারি গার্ডের দুই জেনারেলসহ একাধিক কর্মকর্তা মারা গিয়েছেন। মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে, ইরানের সেনাবাহিনীর কর্তারা দামাস্কাসের ওই কনস্যুলেট দফতরে বসে নাকি প্যালেস্তিনীয় ইসলামিক জেহাদি যোদ্ধাদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন।

ইসরায়েলি গোয়েন্দারা সেই তথ্য পেয়ে যায়। প্যালেস্তিনীয় যোদ্ধাদের নিশানা করেই ইসরায়েলি সেনা হামলাটি চালায়। আসলে এটা ছিল ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষ থেকে একটা উসকানিমূলক আক্রমণ।

দামাস্কাসের ওই হামলার পরেই ইরান প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে দেয়। মার্কিন গোয়েন্দাদের দেয়া সময়সীমা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে ইরান পালটা হামলা চালিয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু করে প্রায় ঘণ্টাপাঁচেক যেভাবে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা চমকে দিয়েছে বিশ্বকে। ইসরায়েলের আকাশ যে সত্যিই সুরক্ষিত, তার প্রমাণও অবশ্য মিলেছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার সময় ‘আয়রন ডোম’ কাজ করেনি। হামাস নাকি ‘আয়রন ডোমানাখা প্রযুক্তিটি অচল করতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু ইরানের হামলার সময় প্রত্যক্ষ করা গেল, দূরপাল্লা ও মাঝারিপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন আকাশে প্রতিরোধ করার প্রযুক্তি ইসরায়েলের যথেষ্ট আঁটোসাঁটো যদিও সমর বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার কাজে বড় ভূমিকা ছিল মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও জর্ডনী সেনার এ আক্রমণে ইসরায়েলি বায়ুসেনার একটি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র সামান্য ক্ষয়ক্ষতি, ঘটিয়েছে। কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিকও অল্পবিস্তর আহত হন। এক আরব বেদুইন বালিকার আঘাত গুরুতর। কিন্তু ইরানের ৩০০টি চার ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই প্রতিহত হয়েছে।

হামলার মধ্য দিয়ে ইরান তাদের বাহিনীর পালটা আঘাত হানারও ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ইসরায়েলের সাধারণ মানুষের প্রাণহানি কিংবা অসামরিক ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো ইরানের লক্ষ্য ছিল না বলে বলা হচ্ছে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, তাদের লক্ষ্যপূরণ হয়েছে। শোধবোধ হয়ে গিয়েছে।

কারণ, ইরানও নাকি চাইছে না, এই ঘটনাটি একটি বড় যুদ্ধের আকার নিক। ইরানের এই হামলার কীভাবে জবাব দেয়া হবে, তা নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা দীর্ঘ বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে আবার একটি বড় যুদ্ধ কিছুতেই চাইছে না। মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলের উপর চাপ তৈরি করেছে পালটা প্রতিশোধে না যাওয়ার জন্য।

আমেরিকায় এ বছর ভোট। মধ্যপ্রাচ্যে আবার একটা যুদ্ধের অর্থ মার্কিন অর্থনীতির উপর চাপ। কোভিড মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মার্কিন অর্থনীতি জেরবার। আমেরিকায় গত কয়েক বছরে যে-হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি। অর্থনীতি কার্যত মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে।

ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলার সামরিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করার জন্য প্রবল চাপ রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপর। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করতে হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বলে মার্কিন সমর-বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ইরানের সমর্থনে রয়েছে চিন, রাশিয়া। রাশিয়া এরই মধ্যে ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। আমেরিকা হামলায় অংশ নিলেই তারা ইরানের হয়ে নামবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মুসলিম ভোট হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও কাজ করছে বাইডেনের।

সেটা ঘটলে বেশ কিছু ‘সুইং স্টেট’ তার হাত ছাড়া হতে পারে।

ইসরায়েল-ইরান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে ভারত সরকারও। ইরানের হামলার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এই দাম আকাশ ছোঁবে। কারণ বন্ধ হয়ে যাবে হরমুজ প্রণালী। যেখান দিয়ে পরিবহন করা হয় বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ অশোধিত তেল। অশোধিত তেলের দাম চড়া হারে বেড়ে গেলে ভারত সরকারের পক্ষে পেট্রল-ডিজেলের দাম ধরে রাখা মুশকিল হবে। ভোটে প্রক্রিয়ার মধ্যে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াতে হলে শাসক দল বিজেপির পক্ষে সেটা এক অস্বস্তিকর ঘটনা হবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে চাপের মধ্যে। হামাসের হামলার পর দেশের মধ্যে তার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে। ১৩০০ ইসরায়েলির মৃত্যুর বদলা নিতে তিনি যেভাবে গাজায় ৩৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, তাতে বহির্বিশ্বেও তার উপর প্রবল চাপ।

গাজা থেকে নজর ঘোরাতেই যদি নেতানিয়াহু সিরিয়ায় ঢুকে ইরানের দূতাবাসে হামলা করে এই সংকট তৈরি করে থাকে, তাহলে যে উত্তেজনাকে বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ফলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে, তা এখনও সুস্পষ্ট নয় কূটনৈতিক মহলের কাছে। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে-মধ্যপ্রাচ্য। যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য বলেই তার আশঙ্কা।