ঢাকা ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্বাচনে কোণঠাসা বাইডেন

অলোক আচার্য, লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
নির্বাচনে কোণঠাসা বাইডেন

নির্বাচনে দুই প্রার্থীর তর্ক এবং বিতর্কে বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি এতটাই গুরুত্বসহকারে দেখা হয় যে, বিতর্কে জয় পরাজয় রীতিমতো ভোটারদেরও প্রভাবিত করে। এমনকি নিজ দলেও শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। যেমন- প্রথম বিতর্কে ট্রাম্পের কাছে কোণঠাসা হওয়ার পর বাইডেনে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়েই ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। এরপরই অবশ্য দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বাইডেন এবং তার স্থলে আসেন কমলা হ্যারিস। এবং এখন পর্যন্ত কমলা হ্যারিসই ট্রাম্পকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পেরেছেন এবং সম্প্রতি বিতর্কে ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করার পর নিজের অবস্থান আরো শক্ত করেছেন তিনি। এই বিতর্কে ভোটারদের মন জয় করতে পারলেন না যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেটা তিনি পেরেছিলেন বাইডেনের সাথে। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে নির্বাচনি বিতর্কে বড় ব্যবধানে হারলেন তিনি। স্বাধীন গবেষণা সংস্থা এসএসআরএস পরিচালিত সিএনএনের জরিপে দেখা গেছে, বিতর্ক উপভোগ করা বেশিরভাগ দর্শক কমলা হ্যারিসের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। জরিপের ফল অনুযায়ী, ৬৩ শতাংশ দর্শক কমলা হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, ৩৭ ভাগ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। বিতর্কের আগে নিউইয়র্ক টাইমসের এক জরিপে ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দেয়া হয়েছিল। এমনকি হ্যারিস এবং ট্রাম্পের নিজেদের সমর্থকদের মধ্যেও বিতর্কের পর বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে। যেখানে হ্যারিসের ৯৬ শতাংশ সমর্থক মনে করেন তিনি বিতর্কে ভালো পারফর্ম করেছেন, সেখানে কেবল ৬৯ ভাগ ট্রাম্প সমর্থক বিতর্কে নিজেদের নেতার পারফরম্যান্সে খুশি। বিতর্কে হ্যারিসের বক্তব্য এবং যুক্তির মুখে বেশ কয়েকবার ট্রাম্প মেজাজ হারিয়েছেন- এটাকেও হ্যারিসের বড় সফলতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অথচ গত বিতর্কে ট্রাম্প ৬৭ ভাগ দর্শকের ভোট পেয়েছিলেন, ৩৩ শতাংশ দর্শক ছিলেন বাইডেনের পক্ষে। তবে কয়েক মাসের ব্যবধানে দৃশ্যপট বদলে গেছে।

এখন কমলা হ্যারিসের চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যাকফুটে চলে গেছেন ট্রাম্প। এরপর আর বিতর্ক হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আর কোনো বিতর্কে অংশ নিবেন না এমনটাই বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে দুই প্রার্থীদের ভিতরকার এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করার ইতিহাস বেশ পুরাতন। যদিও এই বির্তক শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ফলাফলে কতটা প্রভাব বিস্তার করে সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিতর্কে জয়- পরাজয় যে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ তা এক বাক্যে বলা যায়। ১৯৬০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন দুই দলের দুই প্রার্থী জন এফ কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সন। প্রথম সেই টেলিভিশন বিতর্কে ভোটারদের কাছে কেনেডির বক্তব্যই বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। যা স্পষ্ট হয় নির্বাচনের ফলাফলে; ০.২ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জন এফ কেনেডি। প্রায় সাত কোটি ভোটারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল দুই প্রার্থীর পোশাক এবং তাদের বাচনভঙ্গী। সেই যে বিতর্কের শুরু তা আজও চলছে। ট্রাম্প ও বাইডেনের বয়সের ব্যবধান কাছাকাছি থাকলেও কমলা হ্যারিসের সাথে তার বয়সের বড় ব্যবধান রয়েছে। বয়সের ভারে যে কথা উঠেছিল এখন তা কমলা হ্যারিসের সাথে যুক্তিসঙ্গত হয় না। তবে দর্শক জরিপ যা-ই বলুক না কেন, ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেছেন বিতর্কে তিনিই জিতেছেন। তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন তৃতীয় কোনো বিতর্ক হবে না। যদি তাই হয় তাহলে মার্কিন নির্বাচনের আগে মুখোমুখি কথার ও যুক্তির লড়াই আর দর্শকরা দেখতে পারবেন না। এই বিতর্কের পরপরই দুই প্রার্থী মনোযোগ দিয়েছেন তাদের নির্বাচনের প্রচারে।

দুইজনের চোখই এখন সুইং স্টেটে। এসব স্টেটের ফলাফলই নির্বাচনে ফল পাল্টাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন দিনগুলোতে কমলা ও ট্রাম্প-উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ সব দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে প্রচারণা জোরদার করবেন। নির্বাচনের ফল যে কোনো পক্ষে যেতে পারে, এমন দোদুল্যমান চার অঙ্গরাজ্য-নেভাদা, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও অ্যারিজোনা। কারণ দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘রাস্ট বেল্ট’ এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় ‘সান বেল্টের’ কয়েক হাজার সিদ্ধান্তহীন ভোটার পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। যা-ই হোক, বিতর্ক নিয়ে এত আলোচনা হয় কারণ বিভিন্ন বিতর্কে পরাজয় যেমন প্রেসিন্ডেট প্রার্থীর বিপদের কারণ হয়েছে তেমনি নিকট অতীতেও এমন উদাহরণ আছে যেখানে বিতর্কে জয় লাভ করেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে হিলারি ক্লিনটনের বিতর্কে এগিয়ে ছিলেন ক্লিনটন। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। এর বিপরীত ঘটনাও অবশ্য রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক ভিনসেন্ট পন্স এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের পিএইচডি শিক্ষার্থী ক্যারোলাইন লা পেনেক-কেলদোচৌরি ১৯৫২ সাল থেকে ৯টি দেশের ৬১টি নির্বাচনে ভোটাররা কখন প্রার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন এবং তাদের ওপর টেলিভিশন বিতর্ক কতটা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে গবেষণা করেন। নির্বাচনের আগে ও পরে ১ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের ওপর করা সব জরিপ তারা বিশ্লেষণ করেন, এর ৮০ শতাংশ বিতর্ক দেখেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত তাদের গবেষণার ফল হচ্ছে, বিতর্ক নির্বাচনের ফলাফলে কোনো প্রভাব রাখেনি। এমনকি বয়সে তরুণ এবং যারা নির্বাচন বিষয়ে কম খোঁজখবর রাখেন, তাদের পছন্দ বদলাতে পারেনি।

যাই হোক তবুও বিতর্ককে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করা হয়। এটা এক ধরনের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচন বেশ ঘটনাবহুল। এর আগে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে কি না তা ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে তবে এবার তা হয়েছে। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে এবং তিনি আহত হয়েছেন। দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে কমলা হ্যারিস জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পকে ছুঁয়ে ফেলছেন। যে ব্যবধান বাইডেনের সময়ে তৈরি হয়েছিল তা এখন কমে আসছে। কমলা হ্যারিস যে ট্রাম্পের বিপরীতে শক্ত এবং যোগ্য প্রার্থী তা প্রমাণিত হয়েছে। বিতর্কের ঠিক আগে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজ। তাতে দেখা গেছে, পুরো যুক্তরাষ্ট্রকে হিসাবে নিলে জনসমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। এই জরিপে তিনি পেয়েছেন ৪৮ পয়েন্ট। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা ৪৭ পেয়ে ১ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর হিসাবে উইসকনসিন, মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ায় সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন ৫৯ বছর বয়সি কমলা। আর নির্বাচনের ফল যে কোনো পক্ষে যেতে পারে, এমন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে দুজনের অবস্থা সমানে সমান। নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের হিসাবে বড় ভূমিকা রাখে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো। সেদিনই আরেকটি জরিপ প্রকাশ করে সিবিএস ও ইউগভ। তাতে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোয় ট্রাম্প-কমলার তুমুল লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই জরিপ অনুযায়ী, মিশিগানে ৫০ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন কমলা। ১ শতাংশ কম পেয়েছেন ট্রাম্প। আর উইসকনসিনে ২ শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে কমলা। পেনসিলভানিয়ায় দুজনই সমান সমর্থন পেয়েছেন। এখান থেকে স্পষ্ট যে ক্রমেই ব্যবধান ট্রাম্পের থেকে কমিয়ে ফেলছেন কমলা হ্যারিস। নির্বাচনে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে বিতর্ক নিয়ে বেশ সরগরম হয়ে আছে মার্কিন রাজনীতি। আগামী বিতর্ক যদি হয় তবে আবার একটি জমজমাট বিতর্ক দেখা যেতে পারে সম্ভ্যাব্য দুই প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত