ঢাকা ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার বন্যপ্রাণী জীববিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ

আশিকুর রহমান সমী
প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার বন্যপ্রাণী জীববিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ

ফ্রান্সের বিখ্যাত University of Bordeaxu -এ পাখির উপর পিএইচডিরত বাঙালি ছাত্রটির সুপার ভাইজার তার ছাত্রের মাঠ পর্যায়ের পরিশ্রম, অধ্যবসায়, দিন-রাত এক করে কাজ করা, প্রচণ্ড বরফপাতের সময় ও একনিষ্ঠভাবে কাজ করা দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি যেভাবে কাজ করো একদিন তো বরফের নিচে চাপা পড়ে মরে যাবে’। বাঙালি ছাত্রটি তার পরিশ্রম এর ফসলও পেয়েছিলেন, ডিসটিংকশনসহ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার, বাংলাদেশে নীরবে-নিভৃতে বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সংরক্ষণ করে যাওয়া একজন মানুষ এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী জীববিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় যে মানুষগুলো আমাদের পথিকৃৎ, যাদের হাত ধরে আমাদের দেশের প্রাণ-প্রকৃতি, বন্যপ্রাণীর রক্ষা ও সংরক্ষণের কাজের শুরু, বন্যপ্রাণী বিষয়ে যাদের গবেষণার ফলাফল আলোকিত করেছে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীতে তাদের মধ্যে প্রথম কাতারে যার নামটি আসবে, তিনি হলেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার মধ্যে একজন খ্যাতিমান বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। সারাজীবন নিভৃতে, বন-বনানীর মাঝে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন প্রাণ প্রকৃতির গবেষণায়। সাল, ১৯৩৭। যমুনা, বড়াল, ইছামতি, করতোয়া, ফুলজোড়া নদী, চলনবিল নিয়ে সিরাজগঞ্জের উর্বর ভূমি, আর অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই জেলার কুচিয়ামারা থানার, বড়ঘোনা গ্রামে সরকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। ওই যে, কথায় আছে, প্রকৃতি আপন মনে তৈরি করে তার সন্তানকে, প্রস্তুত করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। নতুন পথ তৈরি করার জন্য, যে পথ অনুসরণ করবে হাজারো পরবর্তী পথিক। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আর পাখির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিলো এই মানুষটির। নিজে সব সময় গাছ লাগাতেন। মায়ের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে কিনতেন নতুন গাছ। ছোট বেলা থেকেই আগ্রহ পাখির প্রতি। আর স্কুল ছিলো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। মাঝে ছিলো চলন বিলের অংশ। সাতরে পার হতে হতো ওই বিল। এরপর উল্লাপাড়া মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে করেন ম্যাট্রিক পাস। ভর্তি হন সরকারি আজিজুল হক কলেজ বগুড়ায়। সেখান থেকে করেন উচ্চমাধ্যমিক পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে যোগদান করেন এই বিভাগের শিক্ষক হিসাবে। বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের প্রথম বন্যপ্রাণীবিদ এমিরেটস প্রফেসর ড কাজী জাকের হোসেন স্যারের পরপরই যে নামটি উঠে আসে তা হলো প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। উনি নিজে প্রফেসর ড. কাজী জাকের হোসেন স্যারের ছাত্র ছিলেন। বাংলার জলে-জঙ্গলে, পাহাড়ে, সমুদ্রে সর্বত্রই শুরু হয় ড. সোহরাব উদ্দীন সরকারের বিচরণ। প্রকৃতিকে তিনি জীবনের সবটুকুই দিয়েছিলেন। মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে, সাগরদ্বীপে কখনো বা সুন্দরবনে। মানুষটি খেতে ভুলে যেতেন, পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে পেছনে রেখে এক মনে কাজ করে যেতেন। স্বল্পভাষী এই মানুষটি যে কোনো বিষয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করতেন। কখনো কখনো মাসের পর মাস তার কোনো খোঁজ মিলতো না, কোথায় আছেন। কোন অরণ্যে বন্যপ্রাণী গবেষণায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আজকের মতো এতটা উন্নত ছিলো না, ছিলো না বন্যপ্রাণীর তথ্য সংগ্রহে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি, কিন্তু সোহরাব উদ্দিন সরকারের যা ছিলো, তা হলো কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, বন্যপ্রাণী, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। প্রকৃতিও তাকে সময়ের পরিক্রমায় করে তুলেছেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি নন্দিত একজন বন্যপ্রাণীবিদ এবং পরিবেশবিদ হিসাবে। আন্তর্জাতিক ও দেশি জার্নালে রয়েছে তার শতাধিক গবেষণাপত্র। রয়েছে অগুনিত জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকেল। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী নিয়ে শুরুর দিকে যত প্রকাশনা রয়েছে তার অধিকাংশই এই মানুষটির সৃষ্টি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর পূর্ণাঙ্গ বইও প্রকাশ করেছেন তিনি। রয়েছে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও তাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বই। আর তার হাজারো ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে আছেন পুরো পৃথিবীতে, রাখছেন বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাণীর সংগ্রহশালাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অবস্থিত। এই সংগ্রহশালাকে প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার করেছেন সমৃদ্ধ। প্রফেসর ড. কাজী জাকের হোসেনের সাথে বাংলাদেশে ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি এবং বাংলাদেশ বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

লেখক : বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক, বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত