শিক্ষার্থী বনাম পরীক্ষার্থী খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার শিক্ষাদর্শনে পরীক্ষাভাবনা

মো. মনিরুল ইসলাম, পরিচালক, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা একটি বহুমাত্রিক জটিল বিষয়। দেশে চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী, দ্বিগুণ অভিভাবক, লাখ লাখ শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই শিক্ষার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত। শিক্ষা নানাভাবে তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে; প্রভাবিত করে সমগ্র সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিকে। সন্দেহ নেই- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, সুতরাং মেরুদণ্ড সমস্যায় আক্রান্ত হলে সেই সমস্যা পুরো জাতিকে সংক্রমিত করে ফেলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সমস্যায় আক্রান্ত, তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যথাসময়ে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করতে না পারা। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার মূল অনুসন্ধানে আমাদের রয়ে গেছে সক্ষমতার অভাব এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক পরিধির বাইরে গিয়ে শিক্ষা সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টিতেও রয়েছে নানা জটিলতা। রাজনৈতিক বর্ণ ধারণ করলে শিক্ষা মূল উদেশ্য থেকে পথহারা হয়ে পড়ে। সমস্যাটি আজকের নয়- শতবছরের পুরোনো এই সমস্যার বৃত্তে আমরা চক্রাকারে ঘুরছি। ঊনিশ শতকে ভারতবর্ষের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনৈতিক সমস্যাটি প্রথমবার বেশ উদ্বেগের সাথে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ‘টির্চাস ম্যানুয়েল’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন- বাঙালা দেশের শিক্ষা সমস্যার সহিত রাজনৈতিক সমস্যা জড়িত। শতবছর পরে এসেও আমরা একই কথা শুনছি। এখনকার প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদ তার ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর’ বইয়ে শিক্ষার মূল প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করতে গিয়েও প্রায় অভিন্ন উচ্চারণ করেছেন- ‘শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বৈততা আমাদের হতাশার প্রধান কারণ। শিক্ষাকে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রেখে সমস্যার সমাধান করতে হবে। শিক্ষার সূচনাকাল থেকে আজ অব্দি যে পদ্ধতিটি আমাদের সবচেয়ে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে তা আমাদের ‘পরীক্ষা’। দীর্ঘকাল এই পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আমাদের এখানে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কখনো নম্বর- ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস; কখনো জিপিএ- এ প্লাস, বি প্লাস; আবার কখনো ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ দিয়ে মূল্যায়ন। আবার কখনো সৃজনশীল, কখনো উদ্দীপকের আলোক, কখনো বহুনির্বাচনির ঝলক দিয়ে মূল্য বিচার। শিক্ষার্থীরা কী শিখল, কতটা শিখল তা নয়; কেমন ‘রেজাল্ট’ করল, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটাই হয়ে উঠেছে মূল্যবান।

গত শতকের শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পরীক্ষা পদ্ধতির এই গতানুগতিক ধারার বিপরীতে একটি নৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তা ও পদক্ষেপ পরীক্ষা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক এবং প্রথম মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে কাজ করার সুযোগ পেয়ে বঙ্গ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি গুরুতর পদ্ধতিগত ত্রুটি চিহ্নিত করেন। তখন পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীদের নাম লেখা হতো। ফলে খাতা মূল্যায়নের সময় সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকতো। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার বিরোধিতা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে রোল নম্বরের প্রবর্তন করেন। তাতে শিক্ষার্থীকে মূলায়নে সাম্প্রদায়িক পথ রুদ্ধ হয় এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হয়। পরীক্ষা পদ্ধতিতে এরকম সংস্কারসহ শিক্ষাক্ষেত্রে তার নানা অবদান আমাদের সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু তার কিছু চিন্তা বাস্তবায়ন করা গেলেও অনেকটা আজও উপেক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপটে শিক্ষা সংস্কারের যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সেখানে তার পরীক্ষাভাবনার ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সমন্বয় নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা প্রথমেই পরীক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন- জ্ঞানের বিচার করা নয়, বরং জ্ঞানের সম্প্রসারণ করাই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তিনি লিখেছেন, ‘পরীক্ষার মূখ্য উদ্দেশ্য ভ্রম জানিতে পারা এবং ভবিষ্যতে যাহাতে ভ্রম না হয় তাহার জন্য চেষ্টা-সাধন। বস্তুত, পরীক্ষার উদ্দেশ্য যে কেবল ছাত্রদের জ্ঞানের অবগতি তাহা নহে, শিক্ষাদানও পরীক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য।’ কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার নগদ লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল এবং তা এত উগ্রভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে যে, বাকি লক্ষ্যগুলো বাকিই থেকে যাচ্ছে। এখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও বিচার হয় একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর বদলে পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শিক্ষাপদ্ধতি সৃজনশীল হোক বা না হোক, পরীক্ষা পদ্ধতি বছর বছর সৃজনশীল হচ্ছে। তাতে মূল বইয়ের জায়গায় গাইড বই এবং ক্লাসের চেয়ে কোচিং সেন্টার রমরমা হয়ে উঠেছে। লক্ষ্য যদি একমাত্র পরীক্ষাই হয়, তবে সে বিচারে গাইড বই বা কোচিং সেন্টারই বেশি ফলপ্রসূ। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন।

আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত হওয়া শিক্ষার্থীদের অযথা পুরো পাঠ্যবই পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষক-টিউটরের সহযোগিতায় তারা আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু শেখে, প্রায় ক্ষেত্রে মুখস্থ করে। এভাবে কোনো বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয় না, যেটুকু জানা হয় তার কোনো মননশীল চর্চার সুযোগ নেই। ‘সাজেশনভিত্তিক’ লেখাপড়া নিয়ে শিক্ষবিদ আবুল মোমেন যথার্থই বলেছেন- ‘এই কাটছাঁট করা শিক্ষার উপমা হতে পারে পাখা ছেঁটে দেয়া পাখি, যে আর উড়তে পারে না।’ শতবছর আগে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাও এই ‘কাটছাঁট মুখস্থকরণ’ প্রণালীর ঘোর বিরোধিতা করে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি সম্প্রসারিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধন ‘বিচারশক্তির পুষ্টি’। ‘প্রশ্নভিত্তিক’ ও ‘মুখস্থকরণ’ উভয়ই শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধনে যথোপযুক্ত নয়। তিনি বলেছেন, ‘কয়েকটি বাঁধা গৎ মুখস্থ করাইয়া দিলেই বিচারশক্তির পুষ্টি হয় না। ছাত্রকে চিন্তা ও বিচার করিবার অবসর দিলে তাহার চিন্তা ও বিচারশক্তির পুষ্টি হয়।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি উদাহরণের অবতারণা করেছেন- ‘গ্রামোফোনের গান অতি সুন্দর; কিন্তু উহাকে কেহ সুগায়ক বলে না। চৈতন্যহীন যন্ত্র চালাইয়া দিলে উহা নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি গান উদ্গীরণ করিতে পারে। যে বালক নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর শিক্ষা করিয়াছে, তাহাকে শিক্ষিত বলা যায় না; নির্দ্দিষ্ট পথ ছাড়িয়া একটু সরিয়া পড়িলেই সে একেবারে হতবুদ্ধি হয়, কারণ তাহার বিচারশক্তির পুষ্টি হয় নাই- সে স্বাধীন ও নির্ভুল চিন্তা করিতে শিক্ষা করে নাই।’ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন শ্রেণি কার্যক্রমের চেয়ে পরীক্ষা কার্যক্রমে বেশি মনোযোগী। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের কারখানায় খুশিমনেই খাটছেন। কারণ এটি আর্থিকভাবে লাভজনক, কোচিং সেন্টার বা গাইড ব্যবসার ক্ষেত্রে এই বক্তব্য আরো বেশি প্রযোজ্য। তারা ঘন ঘন পরীক্ষার পক্ষে। কিন্তু খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার অবস্থান প্রচলিত এই ধারণার একবারে বিপরীত। তার অভিমত, ‘ঘন ঘন পরীক্ষা ভালো নহে। ঘন ঘন পরীক্ষা হইলে-১. ছাত্রগণ মনে করে যে, পরীক্ষাই জীবনের উদ্দেশ্য, ২. স্বাধীন চিন্তার অবসর থাকে না, ৩. মৌলিক অর্থ উদ্ধারে ছাত্রগণ প্রয়াসী হয় না, ৪. কেহ কেহ সমস্ত বৎসর কোনো কাজ না করিয়া পরীক্ষার দুইমাস পূর্ব্বে পরিশ্রম করিয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ইহাতে জ্ঞানলাভ হয় না।’ তার মতে, ‘পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীর জন্ম হয় নাই; শিক্ষার্থী আছে বলিয়াই পরীক্ষার সৃষ্টি। এই কারণে ঘন ঘন পরীক্ষা হইলে বা কণ্ঠস্থ বিদ্যা দ্বারা গুণাগুণ বিচার করিলে ছাত্রদের মনে হয় এই বিশ্বাস হয় যে, পরীক্ষাতে কোনো প্রকারে নাম্বার পাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।’ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা টেকসই শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবে ‘সুশিক্ষা, সুব্যবস্থা ও সুশাসন’-এর কথা বলেছেন। সুশিক্ষা বলতে তিনি ‘শিক্ষার্থীর মনে বৃত্তিনিচয়ের যুগপৎ পরিপুষ্টি ও পরিবর্দ্ধন সাধন’কে বুঝিয়েছেন। যেখানে পরীক্ষা পাসের সনদ অর্জনের চেয়ে বিদ্যা অর্জনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, ‘পরীক্ষায় কৃতকার্য্যতা কখনো শিক্ষকের লক্ষ্য হওয়া উচিত নহে। জ্ঞানদান ও মানসিক শক্তির পরিপুষ্টি তাহার একমাত্র লক্ষ্য হইবে।’ কিন্তু জ্ঞান ও মানসিক শক্তি বিকাশের আনন্দ সর্বদা পরিস্ফুটিত এবং টেকসই। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেখানে ছাত্রদের সহযোগিতার মনোভাব বিকশিত হয়, পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সেখানে কেবল প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। আর যেখানে উদার সহযোগিতার চেয়ে সংকীর্ণ প্রতিযোগিতাই মূখ্য সেখানে প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে আরো কিছু অনৈতিক বলয় সৃষ্টি হয়। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য উপেক্ষিত থাকার সুযোগে শিক্ষার নানা উপজাত বাজার দখল করে ফেলেছে। পরীক্ষাই সব হয়ে ওঠায় একে ঘিরে নানা অবাঞ্ছিত, বেআইনি ও দুর্নীতি সংক্রমিত হয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে নোটবই, টেস্ট পেপার, সাজেশন, কোচিং সেন্টার, টিউশনি এবং সময়ে সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো বিষফোঁড়া যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। ফলে পণ্যবাজারের মতো শিক্ষাও সিন্ডিকেটের মুঠোবন্দি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে ছাড়ছে।