যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাকে সাধুবাদ জানাই

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত গতিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজ করে যাচ্ছে। দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে যে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রেখে গেছেন, তা থেকে টেনে তোলার কঠিন কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন করতে হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ অন্তর্বর্তী সরকারের সবাই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র সংস্কার ও ভেঙে দেয়া অর্থনীতির মেরুদণ্ড মেরামত করে সোজা করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিদেশি সংস্থাগুলো অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, আর্থিক খাতে সংস্কার, বিনিয়োগ ও সহযোগিতার ঢালি নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্লেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিল। বিগত দুই দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই দপ্তরের কোনো উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের প্রথম ঢাকা সফর ছিল এটি। যুক্তরাষ্ট্র কতটা আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে, তা এই সফরের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বতঃস্ফূর্ত এই সহযোগিতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ‘স্বর্ণ দুয়ার’ খুলে গেছে। এজন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে সাধুবাদ জানাই। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল ছিল বিভীষিকাময়। রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সবদিক থেকে দেশের মানুষকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। তাদের মৌলিক অধিকার বলতে কিছু ছিল না। তার এই স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে রূপ লাভ করা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা অগ্রভাগে থাকলেও এর সাথে শেখ হাসিনার দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং প্রধান বিরোধীদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী যোগ দিয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অবদান ও আত্মত্যাগ সবচেয়ে বেশি। গণঅভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা না থাকলেও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের আগে দেশের গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতাকর্মীসহ ভিন্নমতের মানুষের উপর হামলা, মামলা, খুন, গুমের মাধ্যমে অকথ্য নিপীড়ন, নির্যাতন করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য-বিবৃতি ও বার্ষিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমালোচনা করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যহত করার দায়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি আরোপ করে। যা ছিল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দেশটি অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রে সংকোচন নীতি অবলম্বন করে। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ তার পতনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি ও পতনকে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ ভূমিকা এবং ছাত্র-জনতার প্রত্যক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং বিপুল সমর্থন নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সরকার স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কাজ শুরু করেছে। দলীয় প্রশাসনের সংস্কারের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ভঙ্গুর অর্থনীতি মেরামতের বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আশার কথা, বিশ্বজুড়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যাতে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, এজন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। এরইমধ্যে এর ইতিবাচক প্রভাবে অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। গত দুই সপ্তাহে রেকর্ড ১৪ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময় তলানিতে চলে যাওয়া রিজার্ভ এখন আইএমএফের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এসে যে আর্থিক সহযোগিতার কথা বলেছে, তা দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশটি ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দেবে। অন্যান্য খাতেও সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা উল্লেখ করে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস তার ফেসবুকের এক পোস্টে লিখেছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে প্রতিনিধিদল। যেহেতু বাংলাদেশ আরো ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।’ যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, দেশটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো বেশি সহযোগিতা করতে আন্তরিক ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০ কোটি ডলার দেবে। আর্থিক খাতের সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক দেবে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিনির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাগুলোর এ এক অভূতপূর্ব সাড়া। অথচ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে এমন স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা বলতে কিছু ছিল না। বাংলাদেশ যেন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বের সব সহযোগিতার দ্বার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা ঋণ করতে করতে দেশের মানুষকে ঋণের সাগরে ডুবিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি টাকার বেশি। সুদসহ এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি দেউলিয়ার মুখে নিয়ে গেছে শেখ হাসিনা। এর মধ্যেই চালিয়েছে লুটপাট ও অর্থপাচার। টাকা ছাপিয়ে (প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে মানুষের জীবনকে চরম দুর্দশার মধ্যে রেখে গেছে। অন্যদিকে, বড় বড় প্রকল্পগুলোকে অর্থ লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। পাইপ লাইনে থাকা প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা ছাড়ের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দুর্নীতি ও লুটপাটের শঙ্কায় দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোও তা ছাড়ে ধীরগতি অবলম্বন করে। তারা জানে, কোনো প্রকল্পে অর্থসহায়তা দিলেই লুটপাট হয়ে যাবে। আবার অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা না থাকায় ফেরত নিতে হয়। পাইপলাইনে থাকা এই বিপুল অর্থছাড়ের ব্যবস্থা না করে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা কেবল ঋণ করে গেছে। ঋণ করে ঘি খেয়েছে। উন্নয়নের নামে দেশি-বিদেশি অর্থ লুটপাটের মহোৎসব চালিয়েছে। সিংহভাগ মানুষকে দরিদ্রে পরিণত করেছে। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে দেউলিয়াত্ব থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তিনি অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারাবিশ্বের কাছে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। দেশ পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব এবং দাতা সংস্থাগুলোর আস্থা অর্জন করেছেন। তারা তার উপর নির্ভর করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, তাকে সে ফেডারেল ব্যাংক মনে করছে, যেখানে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। আমরা আশা করব, একটি আত্মমর্যাদাশীল, স্বনির্ভর ও উন্নত দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে এবং তার সহযোগিতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে। এটাও আশা করি, বাংলাদেশের যে ঋণ রয়েছে, তা সুদ মওকুফসহ পরিশোধে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে। বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার চীনকেও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আরো বেশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করার যে অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তা এগিয়ে নিতে দেশের সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।