ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের অবসান কবে হবে!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের অবসান কবে হবে!

সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমান্ত অনুপ্রবেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটা বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ নানা কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়া চোরাচালান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ক্রমেই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চোরাকারবার ও সীমান্ত পারাপার রুখতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলি করার ফলে সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।

সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর নতুন নয়; কিন্তু এটা পুরাতন হলেও আজও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারে স্থায়ী সমাধান হয়নি। প্রতিনিয়তই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) এর গুলিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে এদেশের নাগরিক ফেলানী, স্বর্না দাস, শ্রী জয়ন্তর মতো অসংখ্যদের। বিএসএফ এর এমন নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদ আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়। সেই প্রতিবাদ বেশিরভাগ হয় এমন- ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো প্রতিবাদণ্ডলিপিতে বাংলাদেশ এ ধরনের নির্মম ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

এই তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই প্রায় শেষ আর হয়তো বাকি থাকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পতাকা বৈঠক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই এসব হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে। ভারতীয় বিএসএফের এমন বর্বরতার অবসান কবে হবে কেউ জানে না।

সম্প্রতি নতুন করে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের পর পর দু’টি ঘটনা গণমাধ্যমে খুব আলোচনা-সমালোচনায় রুপ নিয়েছে।

প্রথমটি হলো- ১. সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্তের পাশে জলাশয়ে পৌঁছামাত্র হঠাৎ বিএসএফকে দেখে স্বর্ণা। এসময় সে আতংকিত হয়ে অণুনয়-বিনয় করে বলে আমাদের মেরোনা আইনের আশ্রয়ে নিয়ে নাও। বাংলায় বলা কথাগুলোর প্রতি উত্তরের বদলে বিএসএফ এর বুলেটে বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় স্কুলছাত্রী স্বর্ণার। স্বর্ণা দাস নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ভারতীয় হাই-কমিশনে পাঠানো প্রতিবাদণ্ডলিপিতে বাংলাদেশ এ ধরনের নির্মম ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

অবিলম্বে সীমান্ত হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভূমিকা নেয়ার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বলেছেন, স্বর্ণা দাশের হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যদের বিচারের আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

দ্বিতীয়টি হলো- ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে ধনতলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলি করে শ্রী জয়ন্ত নামে (১৫) এক বাংলাদেশি কিশোরকে হত্যা করে। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা ধনতলা সীমান্তের ৩৯৩ নং পিলার-সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তবে নিহত কিশোরের লাশ বিএসএফ নিয়ে গেছে বলে জানান স্বজনরা। নিহত জয়ন্ত লাহীড়ি ধানতলা ইউনিয়নের বটতলী গ্রামের মহাদেবের ছেলে।

সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ এর বুলেটের গুলিতে নিহতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো- ফেলানী হত্যাকাণ্ড; ১৫ বছর বয়সি এই ফেলানী খাতুনকে হত্যা করা হয় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে। ফেলানী সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে তার পিতার সঙ্গে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরছিল। বাবার সঙ্গে ফেলানী নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করত।

বিয়ের উদ্দেশে সে দেশে ফিরছিল। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের জওয়ানদের গুলিতে নিহত হয় কিশোরী ফেলানী। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ প্রবল আলোড়ন তুলেছিল দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে।

এত আলোচিত-সমালোচিত মামলাটির রায়ে নিহত ফেলানীর পরিবারের দাবি তারা ন্যায় বিচার পায়নি। বিএসএফের আদালত হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যকে বিচারান্তে বেকসুর খালাস দিয়েছে। এরপর মামলাটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গড়ালেও বিচার হয়নি আজও।

সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ বা শূন্যের কোঠায় কেন জানি কোনোভাবেই আনা সম্ভব হচ্ছে না! সীমান্তে অনেক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এটাও অন্যতম।

তা হলো- বছরের শুরুতে ২১ জানুয়ারি ভোরে এক বিজিবি সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ রইশুদ্দিন সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহতের ঘটনাটিতে আবারও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে, আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে গণমাধ্যমে।

এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

বিএসএফের (বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিহত ব্যক্তি যে বিজিবি সদস্য তা তারা বুঝতেই পারেনি কারণ তিনি লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে ছিলেন এবং পাচারকারী দলের সঙ্গেই তাকে ভারতের সীমানার ভেতরে দেখা গিয়েছিল। ‘একজন বিজিবি সদস্য কীভাবে লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে পাচারকারীদের দলে মিশে থাকতে পারেন’ সেটা তাদের বোধগম্য নয় বলেও বিএসএফ মন্তব্য করেছে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী এই প্রশ্নও তুলছে, একজন বিজিবি সদস্য কেন সাদা পোশাকে পাচারকারী দলের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন?

অপরপক্ষে, আমাদের বিজিবি (বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাচারকারীদের ধাওয়া করতে গিয়ে ঘনকুয়াশার মধ্যে নিখোঁজ হয়ে যান তাদের সিপাহী মোহাম্মদ রইশুদ্দিন এবং তাকে বিএসএফ গুলি করে। পরে ভারতের হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় বলে বিজিবিকে জানানো হয় এবং দু’দিন পরে (বুধবার) তার লাশ বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বিবিসি নিউজ বাংলার তথ্য মতে, এই ঘটনায় ভারত আর বাংলাদেশের দুই দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যৌথভাবে তদন্ত করুক, এ আবেদন জানিয়েছে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মাসুম।

তারা বলছে, ভারতের সীমানায় প্রবেশ এবং কথিত পাচারের অপরাধে কখনই মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া যায় না ভারতীয় আইন অনুযায়ী। আর বিএসএফের সাজা দেয়ার অধিকারও নেই। তারা গ্রেপ্তার করে আদালতে নিয়ে যেতে পারত, কাউকে গুলি করে হত্যা কেন করা হলো?

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মৃত্যু দ্বারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধভাবে লোকেদের প্রবেশের চেষ্টা, সীমান্তে গুলিবর্ষণ এবং গবাদিপশু পাচারের ফলে বছরে বহুবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মৃত্যু বোঝায়। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে। হতাহতদের একটি বড় অংশ হল গবাদিপশু ব্যবসায়ী এবং সীমান্তবর্তী জমির কৃষক। তথ্য মতে, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৮০+ বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১,০০০+ বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৪৬ জন বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। বর্তমানে পরিসংখ্যানে আরো যোগ হয়েছে হত্যাকাণ্ড।

অন্য আরেকটি পরিসংখ্যানে একটি মানবাধিকার সংস্থা রিপোর্ট করেছে যে ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, বিএসএফ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ১১৮৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। ২০২০ সালে শূন্য সীমান্ত হত্যার ভারতের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ৪২ জন বেসামরিক নসালে ১৬ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন এবং অন্তত ২২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে।

নানান কারণে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, হাট-বাজারে বেচাকেনা করা, এবং কাজ খোঁজার জন্য অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিজমিতে কৃষিকাজ কিংবা নদীতটে মৎস্য আহরণের জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্তপথ অতিক্রম করতে হয়।

এর মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন ছোটখাটো এবং গুরুতর আন্তঃসীমান্ত অপরাধে নিয়োজিত। সীমান্ত বাহিনী অবৈধ কার্যক্রম মোকাবিলার বাধ্যতামূলক করা হয়, বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য মানব পাচার এবং জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহন।

সরকার সীমান্ত হত্যা বন্ধে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে যখন সোনালী অধ্যায় বলতো, তখনো সীমান্ত হত্যা হতো। এটি বন্ধ করতে যা করণীয় তা করবে সরকার’।

কোনো রাষ্ট্রের সীমানায় কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ করে তাহলে তাকে ধরে আইনের কাছে সোপর্দ করে সে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচারকার্য সম্পন্ন হবে; কিন্তু আইন, আদালতের তোয়াক্কা না করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দেশের স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধানের পদক্ষেপ আরো জোরদার করতে হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত