দর্জি চলেন মর্জি মতো

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যারা দোকানে বসে মেশিনের সাহায্যে কাপড় সেলাই করেন তাদের বলা হয় দর্জি বা টেইলর। কখনও তারা ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট সেলাই করেন। কখনও করেন মেয়েদের জামা, চুড়িদার ইত্যাদি। আজকাল বাজারে রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তা-পাঞ্জাবিও পাওয়া যায়। কিন্তু তবুও কোনো দর্জির দোকানই বন্ধ হয়নি। বরং দেখা যায়, নতুন নতুন টেইলরের দোকান এখানে-ওখানে খুলছে। অনেকেই বলেন, রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট কিংবা জামা-চুড়িদার ইত্যাদি শরীরে ঠিকমতো ফিটিংস ভালো হয়। ঈদের প্রাক্কালে দর্জির দোকানে উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। বিয়ের মৌসুমেও টেইলরের দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। দর্জি যদি মুসলমান হন তবে তাকে বলা হয় খলিফা। এই খলিফা মানে ওস্তাদ। অর্থাৎ, দক্ষ কারিগর। বড় দর্জির দোকানে দু-চারজন কর্মচারীও থাকেন। কেউ বোতাম লাগানোর কাজ করেন। কেউ সেলাই করা নতুন জামা-কাপড় ইস্ত্রি করেন। অন্য কেউ বোতাম ঢোকানোর ঘাই তৈরি করেন। তবে দোকানের প্রধান দর্জি সাধারণত কাপড় কাটার কাজ করেন। বেশিরভাগ দর্জি মিষ্টিমুখে খদ্দেরকে দিনের পর দিন ঘোরান। এজন্যই কথ্যবাংলায় বলা হয়, ‘দিমু দিমু কয় বন্ধে (বন্ধুয়ে) দেয় তো না। এখানে গুণ আছে বন্ধুর, না-ও তো করে না। বারবার তাগাদা দিয়েও লাভ হয় না। যেদিন ওনার মর্জি হবে সেদিনই আপনি সেলাই করা কাপড় পাবেন। কোনো কোনো দর্জির দোকানে ট্রায়াল রুম থাকে। অর্থাৎ সেলাই করা নতুন পোশাকটি পরে দেখা যায় কেমন ফিটিংস হয়েছে যদি ঠিকমতো ফিট না করে, তাহলে কারিগর তা অল্টার করে দেন। মানে সেলাই খুলে আবার নতুনভাবে সেলাই করে দেন। এ সংসারে বিভিন্ন ধরনের লোক আছেন। কেউ কেউ মনে করেন, দর্জি সবসময় কাপড় চুরি করেন। একজন বয়স্ক লোকের ছেলে বাইরে চাকরি করে। সে বাবার জন্য পাঞ্জাবির কাপড় পাঠিয়েছে। বয়স্ক লোকটি সেই কাপড় নিয়ে গেছেন দর্জির দোকানে। দর্জি ওনার শরীরের মাপ নিয়ে বলেন, এক সপ্তাহ পরে এসে নিয়ে যাবেন। লোকটি বললেন, কাপড় মনে হয় একটু বেশি আছে। দর্জি বললেন হতে পারে। লোকটি বললেন, দুটো রুমাল বানিয়ে দেবেন। দর্জি বললেন ঠিক আছে। এরপর দোকান থেকে বেরিয়ে একটু জায়গা যাওয়ার পর লোকটির মনে হলো, রুমাল দুটো বানাতে দর্জি আপত্তি করেননি। হয়তো বাড়তি কাপড়ে একটা পায়জামাও হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি আবার দোকানে ফিরে গিয়ে দর্জিকে বললেন, সম্ভব হলে পাঞ্জাবির কাপড় থেকে বেঁচে যাওয়া কাপড়ে একটা পায়জামাও বানিয়ে দেবেন। দর্জি বললেন, তা সম্ভব হবে না। লোকটি বললেন, একটু চেষ্টা করে দেখবেন। দর্জি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলেন। লোকটি এবার দোকান থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ তার মনে হলো, স্ত্রীর জন্য যদি একটা ব্লাউজ তৈরি করানো যায়, মন্দ হবে না। তাই তিনি পুনরায় দোকানে ফিরে গিয়ে দর্জির নিকট স্ত্রীর জন্য একটা ব্লাউজের আব্দার রাখলেন। কিন্তু সঙ্গে পুরনো ব্লাউজ না থাকায় মাপ দিতে পারেননি। দর্জির তখন বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে। কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ করে রইলেন। এরপর লোকটি দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। দর্জি ওনাকে একটা পাঞ্জাবি, দুটো রুমাল, একটা পায়জামা ও একটা ব্লাউজ দিলেন। কিন্তু সেলাই করা সবগুলো পোশাকই অতি ছোট। বাচ্চা মেয়েদের পুতুল খেলার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। লোকটি এবার দর্জির ওপর রেগে গিয়ে বললেন, এসব আপনি বানিয়েছেন? দর্জি বললেন, তিন মিটার কাপড়ে এর চেয়ে বড় বানানো সম্ভব নয়। আর হ্যাঁ, আপনার পাঞ্জাবির কাপড় থেকে আপনার দুটো আন্ডারওয়্যারও বানিয়ে রেখেছি। এই নিন। আপনি খুশি হবেন ভেবেই এ দুটো তৈরি করে রেখেছি। লোকটি এবার তর্জন-গর্জন করে দর্জিকে গালাগাল দিতে লাগলেন। কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। ওরা জানতে চাইল ব্যাপারটা কী? দর্জি বললেন, তিন মিটার পাঞ্জাবির কাপড় দিয়ে উনি বললেন একটা পাঞ্জাবি, দুটো রুমাল, একটা পায়জামা ও বউর জন্য একটা ব্লাউজ তৈরি করে দিতে। আমি ওনার অর্ডারমতো সব বানিয়ে দিয়েছি। এখন তিনি বলছেন, এসব পোশাক কেবল পুতুলকে পরানো যাবে। কোনো শিশুর গায়েও এগুলো লাগবে না। এখন আপনারা বলুন, আমার দোষ কী? উপস্থিত যুবকরা ওই লোকটিকে বলল, তিন মিটার পাঞ্জাবির কাপড় দিয়ে এতগুলো আইটেমের অর্ডার দেয়া আপনার ঠিক হয়নি। আর দর্জিরও এরকম অর্ডার নেয়া উচিত হয়নি। দোষ আপনাদের উভয়েরই। অতএব, আপনারা নিজেরা মিটমাট করে নিন। দর্জি বললেন, ছোট একটা গামছা দিয়ে পরিবারের সবার শরীর ঢাকা অসম্ভব! এই সহজ কথাটা ওনাকে কে বোঝাবে। দর্জির কাছে কাপড় সেলাই করাতে গিয়ে আমাদের যেমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় তেমনই দর্জিরও অনেক অভিজ্ঞতা হয়। একদিন এক যুবক এক টেইলরের দোকানে এসে জিজ্ঞেস করল, আর কতগুলো কাপড় সেলাই করা বাকি রয়েছে? দোকানের কর্মচারী বলল, আরো অনেক কাপড় সেলাই করা বাকি আছে। আজ সারা রাত কাজ করলেও শেষ হবে না। খবরটা জেনেই যুবকটি চলে গেল। তিন দিন পর যুবকটি আবারো ওই দর্জির দোকানে এসে জিজ্ঞেস করল, কতগুলো কাপড় সেলাই করা বাকি আছে? কর্মচারী বলল, এখনো অনেক কাপড় সেলাই করার বাকি আছে। রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করলেও শেষ হবে না। একথা জেনেই যুবকটি চলে গেল। এর কয়েকদিন পর যুবকটি আবারো ওই দর্জির দোকানে এসে জানতে চাইল, কতগুলো কাপড় সেলাই করার বাকি আছে? তাকে বলা হয় অনেকগুলো। এরপর যুবকটি চলে যেতেই হেড দর্জি তার এক কর্মচারীকে বললেন, যুবকটির পেছন পেছন ফলো করে দেখে আয় সে কোথায় যায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর কর্মচারীটি মুখ কালো করে ফিরে এলো। হেড দর্জি জিজ্ঞেস করলেন, যুবকটি কোথায় গেছে? কর্মচারীটি গম্ভীর মুখে বলল, জানলে আপনি রাগ করবেন। হয়তো আমাকেও খারাপ ভাবতে পারেন। তবুও বলছি, যুবকটি গেছে আপনার বউর কাছে। কেউ কেউ বরযাত্রী যাবেন বলে দর্জির কাছে শার্ট-প্যান্টের মাপ দেন। নির্দিষ্ট দিনে দর্জির কাছ থেকে শার্ট-প্যান্ট না পেয়ে বরযাত্রী হওয়া বাদ দেন অথবা বন্ধুবান্ধব কারো কাছ থেকে শার্ট-প্যান্ট ধার নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যান। কোনো নতুন বড় দর্জির দোকান থেকে পাঞ্জাবি না পেয়ে জামাইয়ের পুরোনো পাঞ্জাবি পরেই বিয়ে করতে যান। ঈদের নতুন জামা দর্জির দোকান থেকে না পাওয়ায় কোনো কিশোরী মুখ ভার করে ঘরেই বসে থাকে। একবার এক ভদ্রলোক টেরি উলের গরম কাপড় নিয়ে এক দর্জির দোকানে কোট বানাবেন বলে মাপ দিতে গেছেন। দর্জি ওই কাপড়ের মাপ নিয়ে বললেন, কাপড় কম আছে। কোট হবে না। তখন ওই ভদ্রলোক কাপড়টি নিয়ে পাশের অন্য আরেক দর্জির দোকানে গেলেন। দর্জি কাপড় মেপে ওই ভদ্রলোকের গায়ের মাপ নিয়ে বললেন, দশদিন পর এসে কোট নিয়ে যাবেন। নির্দিষ্ট দিনে ভদ্রলোকটি দর্জির দোকানে কোট আনতে গেলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন, একটি কমবয়সি ছেলে তারই কোটের কাপড়ে তৈরি একটা কোট গায়ে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। দর্জি হেসে বললেন, আপনার কোট থেকে যে কাপড়টুকু বেঁচে গিয়েছিল তা দিয়ে আমার ছেলেকেও একটা কোট বানিয়ে দিয়েছি। ভদ্রলোক তার কোট গায়ে দিয়ে দেখলেন, নতুন কোট ছোটও হয়নি। বড়ও হয়নি। সুন্দর ফিট করেছে। তাই তিনি দর্জিকে তার মজুরি দিয়ে কোট নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এরপর তিনি গেলেন প্রথম দর্জির দোকানে, যিনি বলেছিলেন কাপড় কম আছে। ওতে কোট হবে না। ভদ্রলোকটি সেই দর্জিকে বললেন, আপনি কীরকম দর্জি? আপনি বলেছিলেন, কাপড় কম আছে। কোট বানানো যাবে না। ওই কাপড়েই পাশের দোকানের দর্জি আমার কোট বানিয়ে বেঁচে যাওয়া কাপড়ে তার ছেলের জন্যও একটা বানিয়ে দিয়েছে। একথা শুনে দর্জি হেসে বললেন, ওই দর্জির ছেলের বয়স মাত্র আট। আর আমার ছেলের বয়স আঠারো। বেঁচে যাওয়া কাপড়ে আমার ছেলের জন্য কোট কিছুতেই বানাতে পারতাম না। আমাদের জীবনটাই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের। তিক্ত এবং মিষ্ট দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই আছে। আছে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতাও। একদিন একজন লোক এক দর্জির দোকানে গিয়ে বলল, এই নিন পাঁচ মিটার কাপড়। আমার পোষা গাধার জন্য একটা জোড়া শার্ট-প্যান্ট বানিয়ে দেবেন। দর্জি বললেন, আপনার শরীরের মাপ দিয়ে যান। এক সপ্তাহ পর এসে নিয়ে যাবেন।