ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আবেগ দিয়ে গণপিটুনি এবং জীবনের বিনিময় ভাত!

শফিকুল ইসলাম খোকন
আবেগ দিয়ে গণপিটুনি এবং জীবনের বিনিময় ভাত!

আবেগ আর অনুভূতি- এ দুটি শব্দের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আবেগ আর অনুভূতি জানতাম ভালো কাজের বেলায় ব্যবহার হয়ে থাকে। মানুষের মনের আবেগ দিয়ে ভালো কাজকে উৎসাহিত করে, আর সেই ভালো কাজ শেষে অনুভূতির মাধ্যমে প্রকাশ করে। এখন দেখছি ঠিক উল্টো। একটা জীবন্ত মানুষকে আবেগের তাড়নায় নাকি গণপিটুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তা আবার এ কথা প্রকাশ পায় ঘাতকের মুখে। তোফাজ্জলও তো আবেগতাড়িত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাঁচার আকুতি করেছিলো, কিন্তু তখন কোথায় ছিলো ছাত্র নামধারীদের আবেগ; একটু কি মায়া লাগলো না? হায়রে বিবেক, হায়রে মানুষত্ব।

কি নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, প্রশ্ন আসতেই পারে এটা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? একটা জীবন্ত মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে। তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়। সকালে বগুড়ায়, বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনে তিন লাশ পড়ে গেল। কোনো সড়ক দুর্ঘটনা না অন্য কোনো দুর্ঘটনা? ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গিয়েছিলেন তোফাজ্জল হোসেন (৩০) নামের ব্যক্তি। চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন শিক্ষার্থীরা। পিটিয়ে মারার আগে তোফাজ্জল হোসেনকে ভাত খেতে দেন শিক্ষার্থীরা। তোফাজ্জল বুঝতে পারেননি এই খাওয়াই তার শেষ খাওয়া। চোরের বিচার কি মৃত্যূ? সে বিচার বাস্তবায়ন কি বেআইনিভাবে? কি শুরু হলো বাংলাদেশে?

তোফাজ্জলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয়েছিলো ভাইয়ের স্ত্রী শরিফা বেগমের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে আটক মেধাবী ছাত্র তোফাজ্জল হোসেন (৩০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার আগে ঘাতকরা মুক্তিপণের জন্য তোফাজ্জলের ভাবি ও মামার কাছে মুক্তিপণ দাবি করেছিল বলে লতিফা বেগম জানান। লতিফা বেগম বলেন, প্রথমে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ২ মিনিটে আমার মোবাইলফোন নম্বরে কল দিয়ে তোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় ঘাতকরা। তোফাজ্জল বলে, ‘আমাকে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধরে মারধর করছে, টাকা চায়’- এতটুকু বলার পরই ফোনটি কেটে যায়। এরপর ১০টা ২৮ মিনিটে আরেকটি কল আসে। তখন ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তিনি বলেন, বুধবার রাতে টাকা চেয়েছিল দিতে পারিনি বলেই আমার দেবরকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ঘাতকরা। আমার স্বামী মারা গেছেন, বাবা থেকেও নেই, পুরুষ বলতে আমাদের কেউ নেই। বর্তমানে আমার দুই সন্তান ও মাকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় আছি। এদিকে তোফাজ্জলের মামা আব্দুর রবও একই কথা জানালেন। বুধবার রাতে তার কাছেও ৩৫ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। টাকা না দিলে তোফাজ্জলকে মেরে ফেলবে বলে জানানো হয়েছিল। খবর শুনে তার মেয়ে তানিয়া ঢাকায় থাকায় ওর সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করে। পরে বৃহস্পতিবার সকালে খবর আসে তোফাজ্জলকে হত্যা করা হয়েছে। কথা হয়েছিল তোফাজ্জলের চাচা ফজলুল হক, চাচাতো ভাই ফারুক হোসেনের সাথে। তাদের সাফ কথা, ওর আপন বলতে কেউ নেই, আমরা ছাড়া। এ বিচার কি আমরা দেখতে পারবো? আমরা এই নৃশসং হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার কথা আমরা ভুলে যাইনি। আমরা মানুষ, কখনোই কোনো কিছু ভুলে যাই না, সব কিছুই মনে থাকে, আবার সব মনে রেখেই কাজ করি। আমরা অপরাধটা একটু বেশিই করে থাকি। আমাদের বোধ কবে ফিরবে কেউ কি বলতে পারেন? জীবন্ত মানুষ হত্যা, কত নির্মমতা। আমরা ভুলে যাইনি সন্তানের সামনে মাকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যার কথা। যখন পরপর এ রকমের ঘটনা ঘটে তখন সরকারসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নড়েচড়ে বসে। কয়েকদিন কথার ফুলজুড়ি এরপর শেষ হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে তোফাজ্জল নামের এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সারা দেশ। এমন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে সর্বমহলের মানুষ; থেমে নেই দেশের শোবিজ অঙ্গনও। তাই আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আর চুপ থাকতে পারলেন না চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সাম্প্রতিক এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ফারুকী। তিনি আক্ষেপ করেই বলেছেন ‘মববাজি’ বন্ধ করার আহ্বান। ‘তুমি যদি স্বাধীনতার মর্ম না বোঝো, তাহলে তুমি স্বাধীনতার স্বাদ হারাবে। আব্বার কাছে শুনতাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকের মধ্যেই জোশ চলে আসছিল যে সে-ই সব। সে নিজেই অভিযোগকারী, নিজেই বিচারক, নিজেই এক্সিকিউশনার। হাতে অস্ত্র আছে, অথবা আছে মবের শক্তি। সুতরাং মারো, মেরে ফেলো। ফল কী হয়েছিল আমরা জানি।’ ফারুকী লেখেন, ‘আচ্ছা, স্বাধীনতার পর না হয় একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল, এমনকি যখন আওয়ামী লীগের কঠিন আঁটুনির ভেতর আটকা ছিল দেশ, তখনও কি আমরা বাড্ডার এক মাকে ছেলেধরা সন্দেহে মারি নাই? রংপুরে নামাজের পর এক মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে মেরে পুড়িয়ে দিই নাই?’ ফারুকী লেখেন, ‘আমি আশা করছিলাম, এই নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে সাথে নতুন দায়িত্বের ব্যাপারটা আমরা উপলব্ধি করব। আমরাও তার মতো আক্ষেপ করে বলতে হয় এটা কেমন স¦াধীন দেশ, এর আগে না হয় ১৫ বছর আওয়ামী শাসন আমলে অপরাধের দায় দিয়েছিলেন জামায়াত-বিএনপির উপর। তার আগে যখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিলো তখন তাহার সকল অপরাধের দায় দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের উপর। কিন্তু এখন দায় কাদের উপর দিবেন? যে বিশ্ববিদ্যালয় বাবা মা সন্তানদের পাঠায় শিক্ষা অর্জন করতে, কিন্তু সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, আদৌ কি কোনো শিক্ষা দেয়া হচ্ছে? তোফাজ্জলকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ও একজন মানসিক ভারসাম্যহীন। হ্যাঁ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েও যদি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত হয় তাহলে তাকে আইনের হাতে তুলে দেয়াটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি; কেন তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হবে। ৫ আগস্টের আগে হারুনের ভাতঘর নিয়ে নানা ট্রল চলছিল। এখন কি হবে না? প্রথমে তোফাজ্জলকে মারধর করে ভাত খাওয়ানো হয়। তখন হয়তো তোফাজ্জল ভেবেছিলেন এই মনে হয় জীবনটা ফিরে পেয়েছেন। ভাত খাওয়ার পরে হয়তো ছেড়ে দিবেন। তখন তার ভাবনা এটাই হবে স¦াভাবিক। কিন্তু কে জানতো এই খাওয়াই তার শেষ খাওয়া? কি পেল তোফাজ্জল। জীবনের বিনিময় ভাত পেলো, কিন্তু প্লেটে থাকা সব ভাতও খেতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমারও একটি আবেগ কাজ করে, ২০১৭ সালে অক্টোবরে আমিও আবেগতাড়িত হয়ে কলাম লিখেছিলাম ‘ডাকসু নির্বাচন হয় না কেন?’ পরে আমার লেখায় উচ্চাদালত সরকারের রুল জারি করার পরই নির্বাচন হয়েছিলো। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার আবেগ আরো বেড়ে যায়। কিন্তু আজ কি হচ্ছে ঢাবিতে? একটি অপরাধ সংগঠিত হলে ক্ষমতায় থাকলে বিপরীত দলের প্রতি দোষারূপ করা আর বিপরীত দলের লোকরা ক্ষমতাসীন দলকে দোষারূপ করা এই প্রবণতা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে, আমাদের বিবেক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি। দেখুন না এখন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, আমরা আবেগে গণপিটুনি দিয়ে জীবন্ত মানুষকে হত্যা করতে পারি।

পরিসংখ্যান যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রতিবছরই সারা দেশে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে গণপিটুনিতে- যদিও সেসব ঘটনার অধিকাংশই ছিল বিচ্ছিন্ন গণপিটুনির ঘটনা। পরিসংখ্যান বলে ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গণপিটুনিতে দেশে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে- যেগুলোর কোনোটায় ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোনো কোনো ঘটনায় সামান্য চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তোফাজ্জলের মৃত্যুটা কেমন হয়েছে? এটা কি ওই রকমের ছেলে ধরার মতো; না...। তোফাজ্জলকে ঠান্ডা মাথায় তিলে তিলে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। এরকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক যে, সাধারণ মানুষ কেন তুচ্ছ কারণে পাশবিক নির্মমতায় আরেকজন মানুষ হত্যায়ও পেছপা হচ্ছে না? তাহলে কি প্রশ্ন আসতে পারে না আইনের শাসন এখন কোথায়? একটা গান রয়েছে ‘দুনিয়াটা নয়রে বেঈমান মানুষ হয় বেঈমান হায়রে মানুষ হয় বেঈমান’। এ গানের সাথে আমিও সুর মিলিয়ে বলতে চাই, এই দুনিয়াটা বেঈমান নয়, এই বাংলাদেশটা বেঈমান নয়, এই বাংলাদেশের পশুরূপি কিছু মানুষ বেঈমান হয়। কিছুসংখ্যক খারাপ মানুষের কারণে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র নষ্ট হয়। আমরা অপরাধের বিচার দেখতে চাই, অপরাধী কোন দলের, কোন গোত্রের, কোন নেতা, কোন নেতার লোক তাও আমরা দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাই অপরাধ কতটুকু, অপরাধের দায়ে সঠিকভাবে বিচার হয়েছে কি না। এমন না হয় তদন্তের জন্য তদন্ত করা, বিচারের নামে প্রহসন, কয়েকদিন বিচার বিচার করে চিৎকার, এরপর লাল খাতায় বন্দি...। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের একটি বিশ্বাস বা আস্থা রয়েছে। যখন সেনাবাহিনীর হাতে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হলো ঠিক এমন সময়ই এমন হত্যাকাণ্ড। কমিশনপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দান আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করছি। পুলিশকে সক্রিয় ও তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত অবদান রাখবে। কারণ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও কাজ করবে অপরাধ দমনে। অপরাধী যেই হোক তারা যে ছাড় পাবে না সে বার্তাও পৌঁছাবে দুর্বৃত্তদের কাছে। আমরা আশা করব, এ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনেও সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। নতুন লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। নিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে ঘুষ-দুর্নীতির চর্চা না হয় সে ব্যাপারে সতর্কও থাকতে হবে।

পরিশেষে- সুযোগ পেলেই মানুষের ভেতরের আদিম পশুপ্রবৃত্তি বেরিয়ে আসতে চায়। ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন মানুষের মধ্যে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তখন বুঝতে হবে যে ওই পশুপ্রবৃত্তিটি কাজ করছে। এজন্য আমাদের মনের সংস্কার করতে হবে, মনস্তাত্বিক পরিবর্তন আনতে হবে, এটা যে শুধু মানুষের বেলায় তা নয় রাষ্ট্রের যারা কলকাঠি নাড়ছে বা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদেরও মনস্তাত্বিক পরিবর্তন করতে হবে। এখন যদি মনে করা হয়, লেখকের লেখা তাই লিখবে আর পাঠকের পড়া তাই পড়বে, মানা না মানা পাঠকের বিষয়। সে হিসেবে আমিও আবেগতাড়িত হয়ে লিখে গেলাম। আমি আবেগ দিয়ে গণপিটুনি দেইনি, আমি আবেগ দিয়ে লিখে মানুষের মনস্তাত্বিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আমাদের মূল্যবোধ ফিরে আসুক, তোফাজ্জলের মতো নির্মম মৃত্যু দেখতে চাই না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত