ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উচ্ছৃঙ্খল জনগণের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
উচ্ছৃঙ্খল জনগণের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ

সম্প্রতি মধ্যযুগীয় কায়দায় নারকীয় দুটি হত্যার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

প্রথম ঘটনাটি হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক (এফএইচ) মুসলিম হলের ক্যান্টিনে চলতি মাসের ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্ত যুবক তোফাজ্জল হোসেন ঢাবি শিক্ষার্থীদের দ্বারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছে। এ ঘটনাটির ভিডিও ফুটেজ আমরা যারাই সোস্যাল মিডিয়ায় দেখছি তারাই চমকে উঠছি। মানবিকতাণ্ডমানসিকতা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট ও ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য ছবি দেখে আমরা আপাতত যেটুকু বুঝতে পেরেছি তোফাজ্জলের উশকোখুশকো চুল, গলায় ঝুলছে তাবিজ, উদোম শরীর তাতে রীতিমতো বোঝাই যাচ্ছে মানসিক রোগী।

নির্যাতনের আগে এই তোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে ঢাবি এক শিক্ষার্থী তাকে সাথে নিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। আবার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নির্যাতনের আগে ক্যান্টিনে তোফাজ্জলকে ডাল-ভাত খাওয়ানো হচ্ছে। খাওয়ানো শেষে কোনো এক শিক্ষার্থী নাকি তাকে জিজ্ঞেস করেছে কেমন খেয়েছে? সে বলেছে ভালো। সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট ভাত খাইয়ে তারপর চোর সন্দেহে তাকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা এটা কেমন বর্বরতা। তোফাজ্জলের পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায় তার মা-বাবা, ভাই কেউ বেঁচে নেই। সে মেধাবী ছিল। সর্বশেষ তার বড় ভাই পুলিশের এসআই ছিলেন সেও নাকি গত বছর লিভার ক্যান্সারে মারা গেছে। আপাতত নিজের পরিবারের বলতে কেউ বেঁচে নেই। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো- পত্রিকার খবরে এসেছে; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রলীগনেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে ক্যাম্পাসে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা। সাবেক জাবি শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করেছে শিক্ষার্থীরা। স্বজনের অভিযোগ, জাবি ক্যাম্পাসে সেদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত চার দফা তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। শেষবার পুলিশের গাড়িতে তোলার পরও তাকে মারা হয়।

এর আগে তিনি ক্ষমা চেয়ে প্রাণ ভিক্ষার আকুতি জানালেও উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা তা কানে তোলেনি। শেষে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক জানান, আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ জুলাই জাবি উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় যুক্ত ছিলেন শামীম। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আট শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

দুটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সংক্রান্তে আমরা পত্রিকার রিপোর্ট, ভিডিও ফুটেজ, স্থির চিত্র দেখে যেটুকু অবলোকন করেছি তা হলো চরম বর্বরতা ও মানবিক বিপর্যয়। ঘটনা দুটি দেখলে মনে হয় মধ্যযোগীয় বর্বরতাকেও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা হার মানিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাবি, জাবি। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিঃস্বন্দেহে মেধাবী তা বলার অবকাশ রাখে না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা দুটিতে দেশ ও বিদেশে সমালোচনা হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও এমন নির্মমতা ও বর্বরোচিত কাজ করতে পারে তা চোখে দেখলেও জানি বিশ্বাস করার মতো নয়।

ইংরেজি ‘মব জাস্টিস’ কথাটা পূর্বেই প্রচলিত থাকলেও ইদানীং এটা নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। মব জাস্টিস হলো জনতা দ্বারা নিজ হাতে বিচার করা। আরো ক্লিয়ার করে বলতে গেলে মব জাস্টিস হলো আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে নিজ হাতে বিচার করা। যখন একটি উত্তেজিত জনতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাউকে শাস্তি দেয় তখন সেটা মব জাস্টিস। কিন্তু এবার শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারধর করে তাড়িয়ে দেয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা সামনে যত আসছে ততই জোড়ালোভাবে উঠে আসছে ‘মব জাস্টিস’ নামে একটি শব্দযুগল।

গত মাসের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। একইসঙ্গে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। তবে এরমধ্যে পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে যারা পালাতে পারেননি তারা পড়েছেন তীব্র জনরোষে। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই গণপিটুনির শিকার হয়। এমন সব ঘটনাকে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ৫ আগস্টের পূর্বে ক্ষমতাশীন দলের আদেশে সরকারি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে নির্বিকারে গুলি চালিয়েছে। ফলে অনেক ছাত্র, জনতা, শিশু, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আহত-নিহত হয়। পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব হত্যার দায় দিয়ে তাদের উপর চড়াও হয়। এ কারণেই অনেক থানা, পুলিশ ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অফিস লুট ও ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছাত্র-জনতার কাছে আপাত দৃষ্টিতে দোষী হয়। সেজন্য তারা ৫ আগস্টের পর কর্ম বিরতি বা বিশ্রামে যায়, কর্মস্থলে অনুপস্থিত। সুযোগ বুঝে অপরাধী চক্ররা সক্রিয় হয়েছে। পুলিশের সাময়িক নিস্ক্রিয়তার ফলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে শুরু হয় হত্যা, লুণ্ঠন, চুরি, অগ্নিসংযোগ, হাট-ঘাট দখল, মাছের ঘের, বাড়ি ও জমি দখল, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্থাপনা ভাঙচুরসহ নানা অপরাধ। চলতে থাকে সর্বত্রই মব জাস্টিস। ইতিপূর্বের থেকে বর্তমানে মব জাস্টিস বেশি হচ্ছে।

পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে ‘ডাকাত’ সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল ৬ ছাত্রকে। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। সম্প্রতি এমন আরো একটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর যার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।

ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরো প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।

মব জাস্টিসের মধ্যে অন্যতম হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কোনো অপরাধী যদি অপরাধ করে তাহলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিসংখ্যান কম নয়।

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘২০০৪ সালে ২০৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০০৫ সালে ৩৭৭টি, ২০০৬ সালে ৩৫২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

গত ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ২০১৭ সালে ১৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৮ সালে ৪৬৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যা ১৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে ৩৮৮টি এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটি কিছুটা কমে ২২২ হয়। আর গত বছর দেশে ৮০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঘটেছে ১৮টি।

২০১৭ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে পুলিশ। বাহিনীটির হাতে ৭০৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। একই সময়ে র‌্যাব ৩৬৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। (তথ্য সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২২)।

দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন বলেছেন, ‘আইনি বিচার সব নৈতিক কর্তব্যের সমষ্টি।’ বলা হয়, ‘আইনের নিয়মে পাওয়া ন্যায়বিচার সভ্য সমাজের স্থায়ী নীতি।’ বস্তুত, প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই নিজস্ব আইন রয়েছে। সে অনুযায়ী সব বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। আর এটার ব্যত্যয় ঘটলে বিচারকার্য বিঘ্নিত হয়, সৃষ্টি হয় অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা বা মব জাস্টিস।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা সরকার পক্ষ থেকে এসেছে। সম্প্রতি ঢাবি, জাবিতে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে সরকার মব জাস্টিসসহ দ্রুত আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮ এর ১২(১) ও ১৭ ধারা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশে প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে ৬০ (ষাট) দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসারদের স্পেশাল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করেছে। মব জাস্টিস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ-প্রসাশনের প্রতি যেন জনগণের একটা আস্থা ফিরে আসে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। সর্ব ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধের পদক্ষেপের মধ্যে প্রথমে পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি-অনিয়ম, দায়িত্বে অবহেলা রোধ, জনগণের বন্ধু হিসেবে পাশে থাকার আস্থা তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের শান্ত করে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিসহ শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও সম্মান বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গ্রাম পুলিশকে তাদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন করা। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে মব জাস্টিস রোধসহ সকল ধরনের অপরাধ রোধকল্পে কমিটি গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রোধে সচেতন হতে হবে। জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে তাদের নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে। সর্বোপরি সকল প্রকার ঘুষ, দুর্নীতি, অবিচার, অনাচার, অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত