আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের সমস্যা আন্তর্জাতিক নদী আইনেই সমাধান হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক আইনের প্রখ্যাত পণ্ডিত ওপেনহাইমসহ সব আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞই এই মত ব্যক্ত করেছেন, যে আন্তর্জাতিক নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যার ফলে নদী অববাহিকার অন্যান্য রাষ্ট্র বিশেষ করে ভাটির রাষ্ট্র ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। উদ্ভূত কোনো সমস্যা বা বিরোধ উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদানের ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে। সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এই মতবাদের প্রতিফলন ঘটিয়ে অনেক আন্তর্জাতিক ঘোষণা, প্রস্তাবনা, ঐকমত্য, কনভেনশন, নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, যা এ বিষয়ে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনের সঠিক অবস্থান নির্দেশ করে।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক দলিল হচ্ছে : ক. ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতি কর্তৃক হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই মর্মে গৃহীত প্রস্তাব যে নিজ ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার পানির প্রয়োজনীয় ব্যবহারে প্রত্যেক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রের যুক্তিযুক্ত ও ন্যায্য অংশ পাওয়ার অধিকার রয়েছে, যা হেলসিঙ্কি বিধি নামে সুপরিচিতি লাভ করেছে; খ. ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব (UN.Doc.A/ 8730.1973) যার অধীন কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে; গ. অনুরূপ একটি শর্ত যা জাতিসংঘের অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়িত্ববিষয়ক সনদেও যুক্ত করা হয়েছে (ধারা-৩০ UN.Doc.A/ RES/3281/XXIX, ১৯৭৪); ঘ. ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব পরিবেশসংক্রান্ত সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা, যেখানে বলা হয়েছে যে এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না; ঙ. ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ-সংক্রান্ত কনভেনশন। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মেনেই এ বিষয়ে অনেক দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারত-নেপাল কসি নদী প্রকল্প চুক্তি (১৯৫৪), গন্দক সেচ ও জলবিদ্যুৎ চুক্তি (১৯৫৯) এবং ভারত-পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি (১৯৬০)।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী অববাহিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পানি ব্যবহার ও পরিবেশ সমস্যার ন্যায়সম্মত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অনেক যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা সফলভাবে কাজ করছে। যেমন- ১. মেকং রিভার কমিশন (কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম); ২. কনভেনশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব দ্য রাইন (জার্মানি, ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গ, দ্য নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ড); ৩. নিল বেসিন ইনিশিয়েটিভ (মিসর, সুদান, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, ইরিত্রিয়া) এবং ৪. সেনেগাল রিভার বেসিন ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (গিনি, মালি, মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল)।
২০১৪ সালের আগে আন্তঃদেশীয় নদীর জন্য জাতিসংঘ প্রণীত কোনো আইন ছিল না। যে নদী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই নদীর পানি উজানের দেশ যদি একতরফাভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে ভাটির দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার উজানের দেশ যদি ভাটির দেশের কোনো ক্ষতি না করে উজানের পানি ব্যবহার করতে চায়, তার জন্যও আইন থাকলে সেই আইনের আলোকে কাজটি সহজ হয়। এসব দিক বিবেচনা করে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনের শর্ত ছিল, ৩৫টি দেশ কনভেনশনের প্রতি অনুসমর্থন করলে তা আইনে পরিণত হবে।
১৯৯৭ সালের কনভেনশনটিতে ৩৪টি দেশ অনুসমর্থন দেয়ার পর দীর্ঘদিন ৩৫তম দেশের অনুসমর্থন পাওয়া যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিন পর ৩৫তম দেশ হিসেবে ২০১৪ সালের মে মাসে ভিয়েতনাম অনুসমর্থন করেছিল। কনভেনশনটির একটি ধারায় বলা হয়, ৩৫তম দেশের অনুসমর্থনের অবব্যহিত পর তা আইনে পরিণত হবে। সেই ধারা অনুযায়ী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীর জন্য জাতিসংঘের আইন প্রণীত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় মানবিক আইন। একসময় পৃথিবীতে নদীকে ঘিরেই জনপদগুলো গড়ে উঠেছিল। যখন ভৌগোলিক সীমাররেখার কোনো ধারণা তৈরি হয়নি, সেই তখন গড়ে উঠেছিল জনপদ। রাষ্ট্রের ধারণা থেকে ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা সবকিছুকে ভাগ করা যায় না। সে জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের নদীস্বার্থ বজায় রেখেই নদীকে ব্যবহার করার দিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে জাতিসংঘ প্রণীত আইন। সুতরাং, আইন মেনে চললে উভয় দেশই পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারবে ও এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ও সমৃদ্ধ হবে।