জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
জামালউদ্দিন বারী
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের চলমান বৈরিতার নেপথ্যে কাজ করছে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস। প্রতিবেশী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনসংখ্যার দেশগুলোকে টার্গেট করতে গিয়ে ভারত এবং ইসরাইল অভিন্ন পন্থায় নিজ দেশের মুসলমানদের উপর বৈষম্য-নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এ দু’টি দেশের প্রায় একই সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটলেও ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা ইসরাইলের সাথে সরাসরি কূটনৈতিক বোঝাপড়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে ভারতের অভ্যন্তরে প্রায় ২০ শতাংশ নাগরিক মুসলমান, অন্যদিকে ভারতের নিকটবর্তী মুসলিম প্রধান প্রতিবেশী এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে একটি বড় কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশদের অনুসৃত নীতি অনুসরণে সাংবিধানিকভাবে ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে মুসলমানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির কারণে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় মুসলমান পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিজরত করেনি। হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরা ভারত নামক রাষ্ট্রটি গড়ে তুলতে মূল ভূমিকা রেখেছিল। বহুধাবিভক্ত ভারতকে একক রাষ্ট্রশক্তিতে পরিণত করতে মুসলমান সুলতান ও মোঘলরা যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, হাজার বছর পেরিয়ে এসে ভারতকে ব্রিটিশদের শৃঙ্খলমুক্ত করে স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর, খান আব্দুল গাফ্ফার খানের মত অকুতোভয় রাজনৈতিক নেতা এবং হাজার হাজার সাধারণ মুসলমানকে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। বহুমত-বহুপথের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পথ বেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভের মধ্য দিয়ে গত ৭ দশকে ভারত যে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল, হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার গ্যাঁড়াকলে তাদের সেসব অর্জন আজ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা হিসেবে ওয়ার অন টেররিজমের এজেন্ডা এবং পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিক মেনিফেস্টো গিলে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের শিখন্ডীতে পরিণত হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিজেপি ভারতকে একটি মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক আঞ্চলিক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট টানতে নরেন্দ্র মোদি সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে একটি মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তুলতে সস্তা ধর্মীয় ভাবাবেগের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েছেন। এতে যথেষ্ট সুফল পেয়ে তিনি ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পশ্চিমের উপর জায়নবাদী ইসরাইলের প্রভাবকে কাজে লাগাতে তৎপর হন। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় নীতির ঐতিহ্য ভেঙে নরেন্দ্র মোদি প্রথম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসরাইল সফরে গিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালে ইসরাইল সফরে গেলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু যেন এক নতুন বিশ্ব জয় করলেন। অভিভুত নেতানিয়াহু ভারত-ইসরাইলের সম্পর্ককে ‘স্বর্গে লেখা বিবাহ’বন্ধন বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকেই হিন্দুত্ববাদী ভারতের উপর জায়নবাদী ইসরাইলি ভূতের আছড় বিস্তার লাভ করতে থাকে। বিশেষত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করে সেখানে দমন-পীড়নের যে সামরিক বুলডোজার ব্যবহার করা হয় তা অনেকটাই গাজায় ইসরাইলি দখলদারিত্বের অনুরূপ।
ইসরাইলের সাথে সামরিক-প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান এবং কৌশলগত বিনিময় ভারতের জন্য এক নতুন দরোজা খুলে দেয়। ইসরাইলের নিরাপত্তা ও অবিভাবকত্বের জিম্মদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের স্বীকৃতি পাওয়ার মূল কারণ সম্ভবত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি এবং ইসরাইলের সাথে নিরাপত্তা-কৌশলগত সম্পর্ক। মোদির ইসরাইল সফরে ভারত-ইসরাইল বৈবাহিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন সিনেটের চেয়ারম্যান রাজা রাব্বানি তেহরানে বলেছিলেন, ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক একটি ইউনিয়নের চেয়েও বেশি কিছু, যা নরকে গর্ভবতী হয়েছে। তাদের এমন অশুভ আঁতাত সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে রাজা রাব্বানি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং ভারতের উদীয়মান সম্পর্ক মুসলিম উম্মাহর জন্য বড় ধরণের হুমকি।’ এরপর গত ৬ বছরে অনেক পানি গড়িয়েছে। এখন আমরা আমাদের আশপাশে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করছি। ইউক্রেনে রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অনেক বড় ঝুঁকি গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে গাজায় ইসারাইলের আগ্রাসন ও নৈমিত্তিক গণহত্যা এক বছরে পর্দাপণ করছে। এক বছরে ফিলিস্তিনের অর্ধেকের বেশি অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় ২০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু প্রায় ৪০ হাজার মৃত্যু এবং প্রায় একলাখ আহত হয়ে হাসপাতালে ও খোলা আকাশের নিচে কাতরাচ্ছে। গাজা উপত্যকার পুরো জনগোষ্ঠী এখন ইসরাইল সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও মানবিক সংকটের সম্মুখীন। এসব নিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ফেরি করা পশ্চিমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ওরা জায়নবাদী ইসরাইলের ইচ্ছাপূরণের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যেই ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। জেনেভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শহরে ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে বিশাল বিশাল র্যালি হচ্ছে। খোদ ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তির দাবি ও নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত বছর ৭ অক্টোবরে হামাসের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড অপারেশনের পর ইসরাইলের শুরু করা গাজাযুদ্ধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থডক্স ইহুদিরা ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমে শত শত ইহুদি গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীই যেন ব্যতিক্রম, ওরা ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’! যেখানে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্ববিবেক ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তখন ভারতে দেখা যাচ্ছে উল্টো স্রোত। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য এখন একদিকে অসম, অমানবিক অন্যদিকে ফিনিক্স পাখির মতো অজেয়, দুর্দমনীয় হামাসের প্রতিরোধে ভীত হয়ে যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানালেও ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধে যেতে লাইন দিচ্ছে। এই যুদ্ধে অনেক পশ্চিমা দেশ ইসরাইলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করলেও ভারত-ইসরাইল অস্ত্র বাণিজ্য ও সামরিক সহযোগিতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ভারত প্রায় ২৫ কোটি মুসলমানের দেশ। কোনো একক রাষ্ট্রে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সর্বত্র ফিলিস্তিনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও ভারতের মুসলমান ও হিন্দুরা ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে কোনো বিক্ষোভ র্যালি করা দূরের কথা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো পোস্টে লাইক দিলেও চাকরি হারাতে হচ্ছে। ফেইসবুকে ফিলিস্তিনের পক্ষের এক পোস্টে লাইক দেয়ার কারণে গত মে মাসে মুম্বাইয়ের একটি স্কুলের অধ্যক্ষ পারভিন শেখের চাকরি হারানোর খবর বেরিয়েছিল।
ভারতে এমন আরো অনেক ঘটনারই খবর প্রকাশিত হয় না। অনুরূপ ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বেও যে ঘটছে না তা নয়। গত বছর নভেম্বরে ডাচ ফুটবলার আনওয়ার এল গাজী ফিলিস্তিনে ইসরাইলের শিশু হত্যার বিপক্ষে এক পোস্ট দেয়ার কারণে জার্মান ফুটবল ক্লাব মেইন্জ তার সাথে চুক্তি বাতিল করে দেয়। বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান আনওয়ার গাজী। জুলাই মাসে সে মামলার রায়ে তার চুক্তি বাতিলকে বেআইনি বলে রায় দিয়ে তাকে ১৭ লাখ ইউরো (২২ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। হিন্দুত্ববাদী ভারতের আদালতে কোনো মুসলমানের পক্ষে এমন রায় কল্পনা করা যায় না। সেখানে মুসলমানরা যত্রতত্র সাম্প্রদায়িক কারণে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ভারতের মুসলমানরা বৈষম্য, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, এটা কোনো নতুন তথ্য নয়।
মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রবাদীরা মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য মুছে দিতে চায়। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির এমন রাজনৈতিক এজেন্ডা পুরো উপমহাদেশে উত্তাপ ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব থেকেও ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও মুসলিমবিদ্বেষী এজেন্ডা নিয়ে মাঝে মধ্যেই আঙুল তোলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক গ্রেগরি স্ট্যান্টন বেশ কয়েকবার ভারতে একটি সম্ভাব্য মুসলমান গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে সতর্ক বার্তা প্রকাশের পাশাপাশি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এমনকি প্রায় একই ধরনের মতপ্রকাশ করা হয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকেও। গত বছর নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওয়াশিংটনে ২০২২ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম রিপোর্ট’ প্রকাশ উপলক্ষে দেয়া বক্তৃতায় ভারতে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহতভাবে আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে’ এবং মার্কিন হলোকস্ট মিউজিয়ামের মন্তব্য উদ্বৃত করে ভারতে একটি ‘গণহত্যার ঘটার আশঙ্কা’র কথাও পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে পুর্নব্যক্ত করা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের নিগড়ে বাঁধা পড়ার পরও ভারতে মুসলিম নির্যাতন ও সম্ভাব্য মুসলিম গণহত্যা বিষয়ে মার্কিনীরা কথা বলছেন, এটা মুসলমানদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তেহরানে ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ফিলিস্তিন, মিয়ানমার ও ভারতের মুসলমানদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার প্রসঙ্গে এসব দেশে মুসলমানদের অধিকার ও নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হওয়ার প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আমরা যদি ভারতসহ অন্যান্য দেশের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন নিয়ে নীরব থাকি, তাহলে আমরা নিজেদের মুসলমান দাবি করতে পারি না। এটি যথার্থই একজন মুসলমান বিশ্বনেতার মত বক্তব্য। এতেই ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার কিছুটা নাখোশ হয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় শুধুমাত্র খামেনীর মন্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয় বলে মন্তব্য করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। ভারতে মুসলমানদের নির্যাতিত হওয়া প্রসঙ্গে খামেনির বক্তব্য ভারত অসার প্রমাণ করতে পারেনি। মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে খামেনির দেয়া বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, ‘ইসলামের শত্রুরা সর্বদাই ইসলামিক উম্মাহ হিসেবে আমাদের অভিন্ন পরিচয়ের ব্যাপারে আমাদের উদাসীন করার চেষ্টা করেছে।’ বিশ্বে অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল হলেও মুসলমানদের মধ্যে কৃত্রিম বিভক্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করে শোষণ-নিপীড়নের পথ অবারিত রাখা হয়েছে। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরানের শক্ত অবস্থানের সাথে সউদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা থাকলে এ যুগে এমন নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হতো না। মুসলিম উম্মাহর চেতনা একটি অভিন্ন দেহের মত। একটি আরেকটিকে প্রভাবিত ও আক্রান্ত করে থাকে। ভারতের শাসকদলের ইসলামোফোবিয়া ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাংলাদেশকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর উগ্রবাদী বৌদ্ধ ও জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যার ঘটনাও বাংলাদেশকে সরাসরি অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পুরো বিশ্বব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দেশে দেশে মুসলিম বিদ্বেষী চক্রান্ত, নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। মুসলমান নেতারা এ নিয়ে তেমন কথাও বলছেন না। অথচ গাজা গণহত্যা চালিয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষকে হতাহত এবং ২৫ লাখ মানুষকে গৃহহীন ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়ার পর এখন হিজবুল্লাহ দমনের নামে লেবাননে বোমা হামলা চালিয়ে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের নতুন ফ্রন্ট খুলতে শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন সিগন্যাল বা অনুমোদন ছাড়া এ সময়ে নেতানিয়াহুর পক্ষে লেবানন আক্রমণে জড়ানোর কথা ভাবা যায় না। ক্ষুদ্র গাজা উপত্যকাকে প্রায় দুই দশক ধরে অবরুদ্ধ রাখার পর সেখানে বছর ধরে প্রতিদিন শত শত টন বোমা হামলা চালিয়ে সব পুরো গাজা শহরকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করা, সব বাসিন্দাকে উদ্বাস্তু করা এবং গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার শিশু-কিশোর, নারীসহ প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ হত্যার পরও যখন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে পারেনি, ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে না পারায় জায়নবাদীদের নতুন করে মুসলমান গণহত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। গত সপ্তাহে লেবাননের রাজধানী বৈরুত ও শহরতলীতে এক যোগে শত শত পেজার ও ওয়াকিটকির সিরিজ বিস্ফোরণে প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত এবং সহস্রাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ইসরাইলী সামরিক বিশ্লেষকরা একে লেবাননে ইসরাইলের বড় হামলার আগে একটি প্রি-অ্যাম্পটিভ অ্যাকশন বলে অভিহিত করেছেন। সেই পেজার বিস্ফোরণের সাথে এক ভারতীয় যুবকের সংশ্লিষ্টতার তথ্যও এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। অতঃপর ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর ইসরাইলী সিরিজ বিমান হামলায় বৈরুতের বেশকিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং এতে অন্তত ১৫ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্সের সাবেক কমান্ডার জেনারেল গের্শন হেকোহ্যোন তাদের নাগরিকদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে লেবাননে স্থল অভিযান চালানোর বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন।
গাজায় যুদ্ধবিরতি. শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির চেয়ে লেবানন, সিরিয়া এবং ইরান পর্যন্ত যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটানোর পন্থাকেই বেছে নিয়েছে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকরা। জায়নবাদের পুরোনো এজেন্ডায় বিগত দুইটি মহাযুদ্ধ ইসরাইল রাষ্ট্রগঠনসহ তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের বিশেষ সুবিধা এনে দিয়েছিল। সেই বিশ্ব ব্যবস্থা এখন পতনের দ্বারপ্রান্তে। আরেকটি মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই পতন ঠেকিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠন এবং তা আরো একশ বছরের জন্য নিরাপদ রাখার এজেন্ডা নিয়ে লেবাননে নতুন ওয়ার ফ্্রন্ট খুলতে শুরু করেছে। ইসরাইলের সাথে স্বর্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হিন্দুত্ববাদী ভারতও তার কল্পিত মহাভারত গড়ার দিবাস্বপ্ন নিয়ে প্রতিবেশী সম্প্রদায় ও দেশগুলোর উপর বহুমাত্রিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত সরকারের অব্যাহত গুম-খুন, গণহত্যা-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে হাসিনার মাফিয়া সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল। দেশের ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। হাসিনা-মোদির ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন ও আক্রমণের নতুন নতুন তৎপরতা এখনো চলছে। গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় দেশের মানুষের ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব যে কোনো শত্রুর মোকাবেলায় বিজয়ী করে তুলতে পারে। জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের গাঁটছড়া ও বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।