ঢাকা ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন ড. ইউনূস

বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন ড. ইউনূস

ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার দেড় মাসের মাথায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অবস্থান ও মর্যাদা এক অনন্য উচ্চতা স্পর্শ করল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে পা রেখেই ড. ইউনূস বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে এক নতুন পটভূমি ও ভাবমর্যাদায় তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক একটি বিরল ঘটনা। প্রতিবছরই বিশ্বনেতারা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে নিউইয়র্কে গিয়ে থাকেন। সেখানে গতানুগতিক শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ডিনার হোস্টিং করার বাইরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করার সুযোগ প্রায় থাকে না বললেই চলে। এবার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে যোগদান এবং একটি নতুন বাস্তবতায় বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে অতি উচ্চে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাইডেন-ইউনূসের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি একটি মাইলফলক ইভেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ড. ইউনূসকে গ্রহণ করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আন্তরিক আলিঙ্গনের ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক নতুন বার্তা দিয়েছে। ছবিই কথা বলে। সে কথা বলেছেন জো বাইডেন নিজেও। তিনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ইউনূস-বাইডেন বৈঠকপূর্ব আলিঙ্গন এবং উভয়পক্ষে নতুন বার্তা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সফরে বিশ্বনেতা এবং বিশ্ব সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গ্রহণ করতে চলেছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্ব মঞ্চে যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের প্রধান রফতানি বাজার এবং উন্নয়ন অংশীদার। জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের মানদ- হিসেবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলোর প্রাধান্য ঘোষিত হয়েছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর তাগিদ ধারাবাহিকভাবে অগ্রাহ্য করেছে হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার। গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদলের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে জনগণের উপর অন্যায্য নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নের পথ বেছে নেয়ায় জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। আমাদের ছাত্র-জনতা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার পথ সৃষ্টি করেছে। সেই বিপ্লবী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্ব নেতাদের কাছে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সুমহান আত্মত্যাগ ও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরছেন। একটি ভগ্ন, ক্ষয়িষ্ণু ও হতাশাগ্রস্ত দৃশ্যের বিপরীতে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট কাটিয়ে তারুণ্যদীপ্ত সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশকেই হাজির করেছেন। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে ড. ইউনূসকে নতুন রূপে আলিঙ্গন করছেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন মূলত জাতিসংঘ মহাসচিবের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বার্ষিক অধিবেশন চলাকালে শত শত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের ভিড়ে ব্যস্ততম জাতিসংঘ সদর দফতরে মহাসচিবের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও খুব সহজ ব্যাপার নয়। জো বাইডেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের একদিন পর আজ জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেসের সাথে ড. ইউনূসের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেই সাথে উন্নয়নের সহযোগিতায় পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এক নতুন বোঝাপড়ায় উপনীত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাইক্রো ক্রেডিট ও সোশ্যাল বিজনেসের ধারণাকে সামনে রেখে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার সে অবদান সারা দুনিয়ায় স্বীকৃত ও অনুসৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ায় ড.ইউনূসের সম্মান, স্বীকৃতি ও মর্যাদার আসন অতি উচ্চ। আজকের ক্রান্তিকালের দুর্বল, ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত ভাব-মর্যাদার উপর ভর করে নতুন সম্ভাবনার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। ঐক্যবদ্ধ তারুণ্য অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। সেই তারুণ্য পুরো জাতিকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বৈরাচারের দোসররা এখনো সক্রিয়, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে লাগাতার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির সাথে ড. ইউনূসের একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা আলোচনায় আসলেও ভারতীয়দের অনীহার কারণে তা বাতিল হয়েছে বলে জানা যায়। লন্ডন-নিউইয়র্কের মতো পশ্চিমা শহরগুলোতে বাংলাদেশের তারুণ্য নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে সেখানে এখনো বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুগুলো ইন্ডিয়ান বলেই তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে বাঁধাগ্রস্ত করতে ভারতীয় শাসকদের অপপ্রয়াস এখন বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা শুধু স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধেই লড়াই করেনি, তারা প্রবল আধিপত্যবাদী ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ সৃষ্টি করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আন্দোলনের দেয়াল চিত্র বা গ্রাফিতি ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে তা বিশ্ব নেতাদের কাছে উপহার হিসেবে তুলে দিচ্ছেন ড. ইউনূস। শুধু তাই নয়, ক্লিন্টন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ সম্মেলনে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের কয়েকজনকে বিশ্বের উদীয়মান নেতাদের সাথে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশি তারুণ্যের এই নতুন পরিচয় এক নতুন ব্র্যান্ডিং হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস।

তিনি শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের ঐক্যের শক্তিকে তুলে ধরেছেন। যে ঐক্য ও ত্যাগ প্রবল স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে সে ঐক্যই পারে সব ষড়যন্ত্র ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্ন্তবর্তী সরকারকে সাফল্যের সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ এই সরকারের সাফল্য প্রত্যাশা করে। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের পাশে থাকতেও দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত