প্রত্যেক মানুষের মর্যাদার সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারই মানবাধিকার। বার্ধক্যে এসে মর্যাদাপূর্ণ জীবন খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। সমাজে মর্যাদাহীনভাবে বেঁচে থাকা কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। শুধু বয়সের কারণে মানুষকে মর্যাদা দিতে হবে, এমন কথা নিয়ে নানান রকমের বিতর্ক সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। মর্যাদা সাধারণত দুই ধরনের, একটি অর্জিত আরেকটি আরোপিত।
অর্জিত মর্যাদা হলো- সমাজের কল্যাণে, মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে, রোগবালাই, দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তির সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত। আর আরোপিত মর্যাদা হলো ব্যক্তিকে পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে অর্পিত দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে প্রাপ্ত। যিনি যৌবনে পরিবারে, সমাজের কল্যাণে যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি কিংবা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন না তার বার্ধক্যে এসে মর্যাদা পাওয়া কঠিন। অর্থবিত্ত, পদণ্ডপদবি, ক্ষমতা দাপট, দখল বাণিজ্য, ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদা ক্ষণস্থায়ী।
জাতিসংঘের আহ্বানে পহেলা অক্টোবর সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়। এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য : বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের বসবাস। দিনদিন বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। একটা সময়ে শিশুর চাইতে প্রবীণের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে। তখন বিপুল সংখ্যক প্রবীণের সেবা যত্ন, চিকিৎসা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
প্রবীণের বয়স বাড়তে থাকলে দীর্ঘ স্থায়ী অনিরাময় যোগ্য রোগের সেবা যত্নের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রশিক্ষিত নিবেদিত জনবলের ঘাটতি এবং পেশার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রবীণ পরিচর্যাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। প্রবীণের পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা প্রধান বলে বিবেচিত হওয়া উচিত কারণ বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মূলত ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে হয়। একটি সক্রিয় স্বস্তিদায়ক, শান্তিপূর্ণ বার্ধক্য যাপনের জন্য ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য বিমা, সর্বজনীন পেনশন, ব্যক্তিগত সঞ্চয়, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন, পরিমিত সুষম খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন, সেবাকর্মীর সেবা গ্রহণের মানসিকতা, সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। বার্ধক্য হলো ব্যক্তির জীবনে সর্বোচ্চ অর্জন। জীবনের শেষ ধাপে পৌঁছাতে অনেকেই পারেন না।
প্রবীণ ব্যক্তিকে নিজের চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়, প্রতিষেধক টিকা, নার্সিং গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা সমর্থন পাবার মতো পরিবেশ তৈরি করতে ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসাসেবা পেয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাধীন জীবনযাপনের চেষ্টা করতে হবে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রবীণ হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ডে কেয়ার সেন্টার, হোম কেয়ার সার্ভিস, প্যালিয়েটিভ কেয়ার, সেবাকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রবীণ ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তুলতে পারে। ব্যক্তির বিশ্বাস, ইচ্ছা, মর্জি, আকাঙ্ক্ষা থেকে অতীতে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে গড়ে উঠার সম্ভবনা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সাশ্রয়ী মূল্যে কিংবা নায্য মূল্যে সেবা দিয়ে প্রবীণকে ভালো করে তুলতে পারে। এমনকি হাসপাতালের বাইরে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক যত্ন দুটো আলাদাবিষয়। স্বাস্থ্য সেবার মধ্যে চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়, রোগ নিরাময়, নার্সিং গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যত্ন স্বাস্থ্য সেবার পরিপূরক না হলেও ব্যক্তির জীবনকে স্বস্তিদায়ক, শান্তিপূর্ণ করতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে।
পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্ক সুসংহত করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য সম্পর্কের অবনতি ঘটানো যাবে না। পারস্পরিক বন্ধন কে মজবুত করতে পরিবারের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক যত্নের সাথে পালন করতে পারলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। পরিবার সুসংহত হলে প্রবীণদের পরিচর্যা পাবার সুযোগ তৈরি হবে। যাদের দৈনন্দিন কাজগুলো করতে অসুবিধা হয় কিংবা স্বাধীনভাবে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে না, তাদের জন্য সামাজিক যত্ন জরুরি হয়ে পড়ে। যেসব প্রবীণ নানা কারণে একাকী হয়ে পড়েছেন কিংবা একাকী থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা নিজেদের অক্ষমতার দরুন কাঙ্ক্ষিত পরিচর্যা পেতে বিলম্ব হচ্ছে অথবা পাচ্ছে না তাদের সামাজিক পরিচর্যার আওতায় আনা জরুরি। সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কিংবা পেশাদার সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা ক্রয় করে চাহিদা পূরণ করতে হবে। স্থানীয় সরকার-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রবীণ সেবাকে সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যে সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যে সকল সেবাগ্রহীতা সেবা মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না, তাদের জন্য তহবিল গঠন করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্দিষ্ট একটা এলাকায় কত প্রবীণ রয়েছে এবং তাদের আর্থ সামাজিক তথ্য সংরক্ষণ করবে। ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে সেবা অব্যাহত রাখতে হবে। দুস্থ প্রবীণদের জন্য তহবিল গঠন করে সেবা অব্যাহত রাখার সুযোগ রাখা উচিত। রাষ্ট্র প্রত্যেক প্রবীণের বক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করবে। দুস্থ অসহায় প্রবীণদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকবে। প্রবীণদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিনোদনের দায়িত্ব পালন করবে। অসহায় দরিদ্র প্রবীণ পরিচর্যার জন্য কারো দয়া, করুনা, কৃপা পার্থী হন, তবে তার মর্যাদাহানি হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করে প্রবীণ পরিচর্যা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। পরিচর্যার জন্য বড় বড় শহরগুলোতে ৫০০ শয্যার প্রবীণ হাসপাতাল, নার্সিং হোম, সেবাকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডিমেনশিয়া ভিলেজ, প্যালিয়েটিভ কেয়ার নির্মাণ করা করা যেতে পারে। এসব জায়গায় সামর্থ্যবান প্রবীণরা সেবা মূল্য পরিশোধ করে মানসম্মত সেবাগ্রহণের সুযোগ পাবে।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক গবেষক ও সংগঠক।