ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিরাপদ জীবনের চ্যালেঞ্জ

অলোক আচার্য
আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিরাপদ জীবনের চ্যালেঞ্জ

মানুষ বাঁচার জন্য খায় না- খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকে, সে এক মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে আমরা মানে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে সত্যটা হলো এরা বাঁচার জন্যই খায়, আবার খাওয়ার জন্য নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয় ও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুরও কারণ হয়। ফলে অন্য দেশের সাথে আমাদের পার্থক্য রয়েছে। আমরা খাদ্যও খাই আবার বিষও খাই। আশ্চর্য হলো অনিরাপদ জেনেও আমরা সেটা কিনে খাচ্ছি। কতটা অসহায় হলে এমন কাজ করতে হয় আমাদের। যদি খাওয়ার বিকল্প থাকত, তাহলে আমরা সম্ভবত না খেয়েই থাকতাম। কিন্তু এর বিকল্প নেই। ফলে খাদ্যে বিষ ও ভেজাল আছে জেনেও আমরা সেটা খাচ্ছি। এরকমটাও বলা যায় খাওয়ার জন্যই আমাদের বহু জটিল অসুখ শরীরে বাসা বাঁধছে। প্রতিদিন ডাক্তারের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। মাসের মোট আয়ের একটি বড় অংশই যাচ্ছে পরিবারের সদস্যদের পেছনে ওষুধ কিনতে। নিরাপদ জীবনের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রয়োজন। আমাদের খাদ্যনিরাপদ করা যায়নি। খাদ্যের ভেতর মিশে থাকা বিষে ঝুঁকিতে রয়েছে স্বাস্থ্য। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে শরীর জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হই। কীটনাশক, কেমিক্যাল ও ফরমালিনের মতো বিষাক্ত উপাদান নানাভাবে আমাদের শরীরে ঢুকছে। এর ফলে চিকিৎসা খাতে আয়ের একটি বড় অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে। গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্য মারা যায় ৯১ হাজার ৩০০ জন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছে, তার প্রায় তিন গুণ মানুষ মারা গেছে ২০২০ সালে। রিপোর্টে বলা কয়েকটি মৌলিক এবং প্রতিদিনের অতি জরুরি পণ্যের মধ্যে প্রধান হলো খাদ্য। আমরা প্রতি বেলায় যে খাদ্য গ্রহণ করছি, তা কতটা নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। আমাদের চোখের অলক্ষ্যে যে খাদ্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে মাঝেমধ্যেই লোভী মানুষের যে ভয়ংকর কারসাজি দেখতে পাই, তাতে বিশ্বাস করাও যায় না।

এমন কোনো খাদ্য হয়তো আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, সেখানে কিছু লোভী মানুষ তাদের কারসাজি করছে না। নিরাপদ খাদ্য পাওয়াটা আজ আমাদের জন্য সত্যি খুব দরকার হলেও তা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র বাড়িতে যখন কোনো কিছু তৈরি করে খাওয়া হচ্ছে অথবা ছাদে নিজের উৎপাদিত সবজি খেতে পারছি, সেটাই যা একটু নিশ্চয়তা দেয়। বাকি সব খাদ্যেই সন্দেহ থাকছে। কোন খাদ্য নিরাপদ আর কোন খাদ্য ভেজাল দেয়া তা চেনার উপায় নেই। সম্প্রতি গবেষণা করে সবজিতে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও ফলমূলে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। শাকসবজির মধ্যে লালশাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। আর ফলের মধ্যে লিচুতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে বেশি। গবেষক দল আম, লিচু, বরই ও পেয়ারার ৮০টি করে মোট ৩২০টি নমুনা পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে তারা ৩৯টি নমুনায় কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি খুঁজে পান, যা মোট নমুনার ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে লিচুতে, ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে আমে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে সম্ভবত নিরাপদ খাদ্য বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। সবটাই অনিরাপদ। এই অনিরাপদ খাদ্য আমি, আপনি সকলেই খাচ্ছি। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো এই অনিরাপদ বিষাক্ত খাদ্য খেয়ে বড় হচ্ছে আমার আপনার আদরের সন্তান। অথচ ওদের সামান্য কষ্ট হলেও আমরা চিন্তিত হই। অথচ নিশ্চিতে ওদের মুখে কত বিষাক্ত খাবার তুলে দিচ্ছি জেনে বা না জেনে। আমরা অসহায়। কারণ চ্যাঁচিয়ে কোনো লাভ নেই। বড়জোর না খেয়ে থাকতে হবে। কতদিন? সুতরাং খেতেই হবে। অন্যরা পারলে আমি কেন পারব না যুক্তি এখানেই। তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে, আমাদের নিরাপদে রাখার। এসব ভেজাল খাদ্য থেকে মুক্তি দেবার। আবার আমাদেরও একটু আওয়াজ তোলার দরকার আছে। একটু প্রতিবাদ করি, অন্তত যেখানে সম্ভব সেখানেই। একজন, দুজন করে দেখবেন একদিন অনেকেই আমাদের দলে এসেছে। ভেজাল খাদ্য তো সেই বিক্রেতাও খাচ্ছে বা যে মিশাচ্ছে সেও খাচ্ছে। তার পরিবারও তো এর বাইরে নয়। সারা বছরই অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন। নামি-দামি ব্যান্ডের নকল করে বাজারে আসছে পণ্য। সেটা আমরা কিনছি না জেনে। একসময় তা প্রকাশ হয়। কিন্তু ততদিনে তো তা আমাদের শরীরে পৌঁছে দিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- যে অসাধু মানুষগুলো মুনাফার জন্য এসব করছে তাদের সন্তানও; কিন্তু কোনো না কোনোভাবে এই ভেজাল পণ্যই পাচ্ছে। তারাও জনগণের সাথে প্রতারণা করছে। খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে এখন কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য খাদ্য আইন-২০১৩ অনুমোদিত হয়। এই আইন বাস্তবায়নের জন্য নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা ২০১৪ তৈরি হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকার জরিমানা রাখার বিধান রাখ হয়েছে। ২০১৫ সালে সালে গঠন করা হয়’ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০১৮ সাল থেকে ফেব্রুয়ারির দুই তারিখকে নিরাপদ খাদ্য দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করে আসছে। একই সাথে ২০১৮ সালে অনুমোদিত হয়েছে নিরাপদ খাদ্য (স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ) প্রবিধানমালা-২০১৮।

একজন ভোক্তা হিসেবেও আমাদের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর চতুর্থ অধ্যায়ে (ক্রমণ্ড৪১) এ উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করিলে বা করিতে প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে-দণ্ডিত হইবেন। আমরা কতজন এটা জানছি। একজন ভোক্তা হিসেবে আমাদের আরো বেশি সচেতন এবং অধিকার সচেতন হতে হবে।

যারা খাদ্যপণ্যে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করে বড়লোক বনে যাচ্ছেন ভেজাল আসলে তাদের নিজেদের মধ্যে। মানুষ হিসেবে তারা সঠিক নয় বলেই তাদের কর্মেও তারা সঠিক নন। পৃথিবীর অনেক দেশে রমজান মাসে খাদ্য পণ্যের দাম কমানো হয়। আর আমাদের দেশে হয় ঠিক উল্টো। দাম যেন এ সময় না বৃদ্ধি পায়, তার জন্য সরকারকে নানা পদক্ষেপ নিতে হয়।

কিন্তু কেন? কেন আমরা নিজেরাই একটু সৎ হই না। আজ যারা মাছে, ফলমূলে ফরমালিন মেশাচ্ছেন, যারা মুড়ি ভাজার সময় ইউরিয়া সার ব্যবহার করছেন, যারা চালে মোম ব্যবহার করে পালিশ করছেন বা মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে, মোটা টাকা কামাচ্ছেন, যারা অখাদ্য কুখাদ্য বাহারি মোড়কে মুড়িয়ে আমাদের খাওয়াচ্ছেন তারাও কিন্তু বাজার থেকে ভেজাল পণ্য কিনেই বাড়ি ফিরছেন। তিনি নিজেও এই চক্রের প্রভাবের বাইরে নন। তিনি তার পরিবারের কাছে কি জবাব দেবেন। তার সন্তান এবং পরিবারের সদস্যরা সেই ভেজাল পণ্যই খাচ্ছেন। তাহলে তার কি লাভ হলো। তিনিও তো ঠকছেন। নিজে মানুষকে ঠকাচ্ছেন সেই সাথে নিজেই ঠকছেন। যে দোকানদার মিষ্টির প্যাকেটে কারসাজি করে ওজন বাড়িয়ে মিষ্টি কম বিক্রি করেন সেই দোকানদার কি বাজার থেকে ঠকছেন না। তাকেও তো বাজার থেকে সেই দুধ কিনতে হচ্ছে, যে দুধে আদৌ দুধই নেই। কেবল জল, পাউডার আর কেমিক্যাল মেশানো রয়েছে। যে বেকারি পঁচা ডিম দিয়ে বিস্কুট বা পাউরুটি তৈরি করছেন তাকেও তো বাজার থেকে চাল, ডাল কিনতে হচ্ছে। তাকেও ভেজাল খাদ্যই কিনতে হচ্ছে। একজন আরেকজনকে ঠকিয়ে পকেট ভারী করে ভাবছি লাভটা অনেক হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ সবই লোকসানের খাতায়। তার পরিবারও সেই ভেজাল খেয়েই অসুস্থ হচ্ছে। তখন তিনি কাকে দোষ দেবেন? তবুও তিনি তার জায়গা থেকে সরছেন না।

দেশকে ভালবাসি এটা প্রমাণ করার জন্য কোন প্রচারের দরকার হয় না। দরকার হয় কাজের। দেশ এমনি এমনি উন্নত দেশে পরিণত হয় না। দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়। ব্যবসায়ীরা এর বড় অংশীদার। কারণ তারা ব্যবসায়ের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। আমি দেশের জন্য কতটুকু কাজ করছি কি কাজ করছি, সেটাই মূখ্য বিষয়। যারা ভেজাল ব্যবসায়ী তাদের ভেতর দেশপ্রেম থাকতেই পারে না। তারা কোনভাবেই দেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। যে যার যার জায়গা থেকে দুর্নীতি করলে দেশটা চলবে কীভাবে? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনো খাদ্যপণ্য কেনার আগেই মনে সন্দেহ জাগে। এই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। আবার না কিনেও কোনো উপায় নেই। উন্নত দেশগুলোতে নিরাপদ খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করতে কঠোর আইনের পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করা হয়। খাদ্যে ভেজাল দেয়াকে মানুষ হত্যার কাছাকাছি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এসব দেশে। আর ভেজাল খাদ্য দিয়ে মানুষকে ক্রমেই মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দেয়া হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সচেতনতার সাথে সাথে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট পাবনা।

Email- [email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত