আমাদের দেশে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে আয়োজন করা হয় বই বিতরণ উৎসবের। আর অনেক দিন ধরেই বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া হয়। এটি বেশ ভালো লাগার বিষয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। অভিযোগটি হলো- এসব বইয়ের কাগজের মান আগের চেয়ে অনেক খারাপ আর ছাপাও নিম্নমানের। এর বাইরে এসব বইয়ের ভুল বানান আর বিভ্রান্তিকর বিভিন্ন তথ্য তো আছেই। এমনকি আমরা বই বিতরণের পর সমালোচনার মুখে কখনো বই প্রত্যাহার করতেও দেখেছি। প্রশ্ন হলো, পাঠ্যবই নিয়ে কেন এই অবহেলা?
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে নতুন বই দিতে সরকারকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি ৭১ লাখ। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এবার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়েছে। বাকি শ্রেণিগুলোতে পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই দেয়া হয়। খবর নিয়ে জেনেছি, জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন নামের একটি সংগঠন আছে। পাঠ্যবইয়ের নানা কারসাজিতে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মানসম্মত বই সরবরাহের দাবি নিয়ে কাজ করে এই সংগঠনটি।
২০২৪ সালে পাঠ্যবই বিতরণের পর তারা নানা তথ্য সংগ্রহ করে একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বই ছাপাতে কাগজের ঔজ্জ্বল্য ৮৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ফলে এবার নিম্নমানের বইয়ের ছাপা হয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছু মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান এই মানের চেয়েও নিম্নমানের কাগজে বই ছাপায়। এতে অনেক এলাকায় ছাত্রছাত্রীরা লেপ্টে যাওয়া বই পেয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিবছরই পাঠ্যবই প্রকাশে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে। আর এতে ভুক্তভোগী হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তারা এমন বিবৃতি দিলেও, সারা দেশে বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে এসবের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ বিগত সরকার নেয়নি। খারাপ লাগার বিষয় হলো, পাঠ্যবই নিয়ে এমন ‘গাফিলতি’ নতুন নয়। আমাদের মনে আছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসংগতি নিয়ে বিতর্কের পর শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ) আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তাছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সবক’টি বইয়ে সেবার ভুলভ্রান্তি ছিল, যা নিয়ে পরে সংশোধনী দেয় এনসিটিবি।
এনসিটিবি কেন বার বার এসব ভুল করেই যাচ্ছে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমরা দেখেছি, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বই তৈরির চেয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অনেকেরই বেশি আগ্রহ থাকে বই মুদ্রণের কাজে। এ নিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মধ্যেই নানা আলোচনা আছে। এ অবস্থায় বই মুদ্রণের কাজটি শুধু এনসিটিবির হাতে না রেখে আলাদাভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে দেয়া যায় কি না ভাবা উচিত। বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার কাজটি কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করে এনসিটিবি? জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও ভোকেশনাল স্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিনামূল্যে বিতরণ করে। আর পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ ক্রয় করে মুদ্রণকারীদের সরবরাহ করে থাকে এনসিটিবি। তাছাড়া কাগজসহ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের কাছে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সব ক্ষেত্রেই সবসময় দরপত্রে বর্ণিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মানসম্মত কাগজে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয় না। এখানে বিশাল অঙ্কের টাকার দুর্নীতি হয়।
সূত্র বলছে, এনসিটিবিতে মুদ্রণ কাজের তদারককারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে নিয়মিতভাবে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি অংশ পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অবৈধভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের সহযোগিতায় মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে রি-সাইকেল্ড কাগজ ক্রয় করে অত্যন্ত নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে। আর নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হলে একদিকে ছাপার মান খারাপ হয়, অন্যদিকে বইও তেমন টেকসই হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ে ছাপানো ছবি থেকে কালি উঠে যায়, ছবি বোঝা যায় না। তাছাড়া এই নিম্নমানের কাগজে নানা ধরনের রোগ-জীবাণু থাকে, যা শিশুস্বাস্থ্য ও চোখের জন্য ক্ষতিকর। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কয়েক বছর আগে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। তারা তখন বলেছিল, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি তৈরি, ছাপা ও বিতরণ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। তাদের প্রতিবেদনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। টিআইবির এই গবেষণায় এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন কমিটির সদস্য, পাণ্ডুলিপি লেখক, সংশ্লিষ্ট সম্পাদক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ, তদারকি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম কর্মীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, এনসিটিবি কর্মকর্তারাও এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদনে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের প্রক্রিয়া চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, এসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শীদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে কাউকে কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়। কোনো ক্ষেত্রে লেখা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের প্রভাব দেখা যায়। আবার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের কোনো কোনো বিষয় এবং শব্দ পরিবর্তন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শিক্ষাক্রম অনুসরণ না করেই অনেক সময় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে লেখা পরিবর্তন করা হয়। পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরা বলা হয়, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একাংশ পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র আহ্বানের আগেই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাক্কলিত দর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে দরপত্র দাখিল করে। বিতরণ পর্যায়েও নানা ধরনের অনিয়ম হয় বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ বিষয়ে বলা হয়, কয়েকটি জেলায় নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ করা না হলেও পরে সঠিক সময়ে প্রাপ্তি প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এনসিটিবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন-প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, সঠিকভাবে পাণ্ডুলিপি রেখা হচ্ছে না, দলীয় রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রভাব বিদ্যমান দেখা যায়। পাঠ্যবই ছাপায় দুই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। প্রথমত, ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা আদায় এবং কার্যাদেশ প্রদানে দুর্নীতি। গত কয়েক বছরে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, প্রায় প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই দিতে এনসিটিবি’র দৌড় শুরু হয় একেবারে শেষবেলায়। আর এ কাজের সাথে জড়িতরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সেই ১৯৮৩ সালের জনবল ও কিছু সেকেলে সিস্টেম কাঠামোতে চলছে এই প্রতিষ্ঠান।
প্রত্যেক বছর সমস্যার কথা শোনা যায়, তাহলে সমাধান হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, আসলে যে কয়জন লোকবল নিয়ে ১৯৮৩ সালে যেভাবে এনসিটিবি গঠন করা হয়েছিল সেভাবেই এখনো আছে। আগে তো এনসিটিবির বই ছাপাতে হতো না। পাবলিক পাবলিশার্সরাই এনসিটিবির পাণ্ডুলিপি ছাপিয়ে সেগুলো বিক্রি করত। এখন ৩৫ কোটি বই ছাপানোর বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এনসিটিবির সেই আগের লোকবল সেটাপ নিয়েই এই বাড়তি লোডের কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। এখানে অনেকেই রিটায়ার্ডমেন্টে চলে গেছেন, অনেক পোস্ট খালি আছে, এর মধ্যেই স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়েই কিন্তু কাজ চলছে। এমনকি কোনো শুক্র-শনিবার নেই, প্রতিদিনই কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এনসিটিবিসহ এর সাথে বিভিন্ন সেক্টরের প্রায় এক লাখ লোক জড়িত। এত বিশাল লোকের কর্মযজ্ঞ ম্যানেজ করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ থাকা দরকার, সেভাবে কিন্তু এনসিটিবিকে তৈরি করা হয়নি।
বিনামূল্যে বই দেয়ার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। এতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি যেমন বেড়েছে, ঝরে পড়াও তেমনি কমেছে। কিন্তু বই ছাপা ও তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে অনেক শিশুর হাতে যাচ্ছে নিম্নমানের মলিন বই। অথচ শিশুদের বই হওয়া উচিত ভালো মানের কাগজে উন্নত মানের ছাপার। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার একেবারে অপরিহার্য প্রধান উপকরণ কিন্তু বই। আর শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই তুলে দেয়ার দায়িত্ব যেহেতু এনসিটিবির হাতে ন্যস্ত, তাই এ বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।