পথশিশুদের মায়ের কোল হলো তাদের নিরাপদ আশ্রয়

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পথশিশু অর্থাৎ ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের পুনর্বাসন তথা তাদের জীবনমান উন্নত করার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দিবসটি পালিত হয়। পথশিশু শব্দটি সেইসব শিশুদের প্রকাশ করে, যাদের কাছে রাস্তাই (বিস্তৃত অর্থে বস্তি, পতিত জমি ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত) তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান অথবা জীবিকা নির্বাহের উৎস হয়ে উঠেছে এবং তারা দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত, পথ নির্দেশনা প্রাপ্ত ও পরিচালিত নয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। মায়ের কোল হলো তাদের নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু পথশিশুরা স্কুলে যায় না। রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে বা অন্য কাজ করে তারা। এর কারণ তাদের বাবা-মা কাজ করতে অক্ষম বা তাদের উপার্জন অতি সামান্য, যা তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট নয়।

ঢাকা ও দেশের আটটি বিভাগের হটস্পটে (যেসব স্থানে পথশিশুর আনাগোনা বেশি) ৫-১৭ বছর বয়সি ৭ হাজার ২০০ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। আর পথশিশুর সংখ্যা কত? এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২৫ লাখ। এরমধ্যে আড়াই থেকে তিন লক্ষাধিক পথশিশুর অস্থায়ী আবাস রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথে। এসব পথশিশু সমাজ-সংস্কৃতির কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। সমাজের দুষ্টচক্রের সাথে নিয়তই তাদের ওঠাবসা। ছেলে শিশুদের ব্যবহার করা হয় মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। মেয়ে পথশিশুদের অধিকাংশই অল্প বয়সে পতিতাবৃত্তির মতো ঘৃণ্য পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮টি মৌলিক অধিকার রয়েছে। এসব অধিকার সুশাসন ও সুনাগরিকের রক্ষাকবচ। এক কথায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়ার সহায়ক শক্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আমাদের দেশে পালিত হয় পথশিশু দিবস। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনিসেফ’ শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে।

শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা আছে। এই উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের পরিচর্যা ও সরকার শিশুদের সেবা এবং সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে। পরিসংখানে দেখা যায়, বিশ্বে শতকরা ২৬ ভাগ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশুই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। একটি জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র শিশুদের ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা, ৫৯ শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১ শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫ শতাংশ বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়।

যেসব শিশু তাদের পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়া বসবাস বা জীবিকা অর্জনের জন্য তাদের বেশিরভাগ সময় রাস্তায় কাটায় তাদের রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এ শিশুদের বেশিরভাগই ছেলে (৮২ শতাংশ) এবং তাদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কি না তা তাদের জানা নেই।

এ শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘর থেকে বঞ্চিত। তারা পাবলিক বা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায় শুধু একটি পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরো বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে।

প্রায় ৭ শতাংশ শিশু সম্পূর্ণ একা ঘুমায় এবং ১৭ শতাংশ শিশু কয়েকজন একসঙ্গে মিলে ঘুমানোর মাধ্যমে সুরক্ষা ও স্বস্তি খোঁজে। শিশুদের প্রতি সহিংসতার প্রতি তিনটি ঘটনার একটি (৩০ দশমিক ৪ শতাংশ) রাতে তাদের ঘুমের সময় ঘটে থাকে।

রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় পথচারীদের দ্বারা। জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করে। জাতিসংঘ শিশুসনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি সবাই শিশু। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগই শিশু।

যেসব শিশু পিতৃ কিংবা মাতৃহীন বা উভয়হীন, মা তালাকপ্রাপ্ত কিংবা বাবা দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, মাদকাসক্ত কিংবা বাবা-মা সংসার চালাতে পারছে না সেসব শিশু ঘরের বাহিরে চলে আসে রাস্তায় বসবাস শুরু করে, তাহাকে পথশিশু বলে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এরা সঠিকভাবে শিশুদের গড়ে তুলতে পারে না। তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেই থকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার প্রদানে ব্যর্থ হয়।

ছিন্নমূল এসব শিশুরাই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদকবাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক প্রভৃতি। তাছাড়া বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়। সেই ভোর থেকে কাজ শুরু হয়ে রাতের অনেকটা সময়জুড়ে ওরা কাজ করে। একটু ভুল হলেই মালিকের হাতে মার খেতে হয়। কখনো কখনো তাকে চাকরি হারাতে হয়। সারাদিনে কাজের ধরন বুঝে ২-৩ বেলা খাবার পায় এই শিশুশ্রমিকরা। দিনশেষে ২০ থেকে ৫০-৬০ টাকা কিংবা মাস শেষে ৫০০-৬০০ টাকা পেয়ে থাকে, যা তাদের শ্রম এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। মালিক পক্ষের কাছে কোনো দাবি তুললেই চাকরিচ্যুত হতে হয়। এভাবেই চলছে তাদের যাপিত কষ্টময় জীবন। এই বিপুল-সংখ্যক পথশিশুদের একটা বিশাল-সংখ্যক অংশই জড়িয়ে পড়ে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।

এছাড়া মিছিল মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে অহরহ পথশিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে কিংবা একবেলা পেটপুরে খাওয়ার বিনিময়ে এসব দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে এসব শিশুরা। শোডাউন ছাড়াও পিকেটিং, ভাঙচুর কিংবা ককটেল নিক্ষেপের মতো বিপজ্জনক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে।

আশঙ্কাজনক হারে বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে পথশিশুর সংখ্যা। এদের বেশিরভাগই অপুষ্টি, যৌনরোগ ও মাদকের নেশায় আক্রান্ত। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পথশিশু।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি ছেলে এবং মেয়ে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আমাদের দেশে পালিত হয় পথশিশু দিবস। আর পথশিশুরা কারো না কারো সন্তান, আত্মীয়-স্বজন। আল্লাহর সৃষ্টি সেরা জীব মানুষ হওয়ার কারণে পথশিশুদেরও রয়েছে ন্যায্য অধিকার। স্বাধীন দেশে এ পথশিশুদেরও সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হওয়ার অধিকার আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। পথশিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে পালিত হোক জাতীয় পথশিশু দিবস।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি