দাবি উঠেছে, ’৭২-এর সংবিধান বাতিল করতে হবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। কেন বাতিল করতে হবে? কেননা, ওই সংবিধান ছিল ভারতের চাপিয়ে দেয়া, যা এদেশের মানুষের আক্বিদা-বিশ্বাসের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল গত ৫২ বছর। মুখে গণতন্ত্র বলা হচ্ছে, অথচ দেশের গণমানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন সেখানে ছিল না। মাঝে জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং পরে জেনারেল এরশাদ ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে যোগ করেছেন। ফলে সংবিধানটি না ইসলামি না সেক্যুলার জগাখিচুড়ী হয়েছে। বাস্তবে গত ৫৩ বছর দেশ চলেছে শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতার উপরে।
ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। সেখানে নেহরু-প্যাটেলদের চক্রান্তে বহু মুসলিম এলাকা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্ত হয়ে গেছে। রাজশাহীর অপর পারে লালগোলা-মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর-জঙ্গীপুর এবং সিলেটের করিমগঞ্জ এবং সাতক্ষীরার কেঁড়াগাছি-ভাদিয়ালী-সোনাবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী সোনাই নদীর অপর পাড়ের হাকিমপুর-তারালী, বসিরহাট মহকুমা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অপরিহার্য ছিল। উচিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর ও নদীয়া জেলার সাথে বাংলাদেশের দিনাজপুর-বিরল ও মেহেরপুরের একীভূত হওয়া। কিন্তু হয়নি কুচক্রী ওই দু‘তিনজন নেতার কারণে এবং বিদায়ী ব্রিটিশ ভাইসরয় র্যাডক্লিফের তাড়াহুড়ায়। এমনকি সাতক্ষীরা-খুলনা-যশোরকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে খুলনা ও সাতক্ষীরার নেতাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের ঝুঁকি নিতে হয়। ফলে ১৪ আগস্টের স্থলে খুলনা-সাতক্ষীরায় পাকিস্তানি পতাকা উঠে ১৭ আগস্টে। এইসব এলাকার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন রাতারাতি ‘পর’ হয়ে গেল। পাসপোর্ট-ভিসার বাধা তাদের চিরদিনের জন্য পৃথক করে দিল। অথচ রক্তে-মাংসে, ভাষায় ও ধর্মে তারা আদৌ পৃথক নয়। র্যাডক্লিফের টানা মানচিত্র সকলের দেহে ব্যবচ্ছেদ ঘটাল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নেহরু গংরা নিয়ে নিলো। কায়েদে আযম বললেন, তাহলে আমার পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা খাবে কী? তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ কী? যুক্তির সামনে হেরে গেল প্রতিপক্ষ। অবশেষে পূর্ব পাঞ্জাবকে তাদের দিয়ে চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামকে নিতে হলো। তবুও গোঁ ছাড়েনি তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যা নেই। মি. জিন্নাহ বললেন, সেখানে পাহাড়ের নিচে রয়েছে তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুত।
এরপরে এল ’৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর নেহেরুর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল পাকিস্তান ২০ বছরের মধ্যে ভেঙে যাবে। হ্যাঁ তাদের ষড়যন্ত্রেই ২৪ বছরের মাথায় পাকিস্তান দু’ টুকরা হয়েছে। কিন্তু না। তারা এতেই থেমে থাকেনি। তারা উজানে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে শুকিয়ে ও ডুবিয়ে মারতে চাইল। এদেশকে তাদের মুখাপেক্ষী রাজ্যে পরিণত করার ছক তাদের ছিল। ফারাক্কার বিপরীতে আইয়ুব খান যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিকটে বাঁধ নির্মাণের জন্য ৮৫ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, তখনই তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেন। অতঃপর মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি স্বাক্ষরের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকায় নেমে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে বলেন, দেশটাকে বিক্রি করে দিয়ে এলি? মুজিব রাষ্ট্রপ্রধান হলেন। ইসলামের প্রতি তার টান ছিল। তাই ভারতের বুকের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোর সম্মেলনে যোগ দিলেন এবং নবগঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য হিসাবে বরিত হলেন। এরপরেই ভুট্টো এলেন। তেজগাঁও এয়ারপোর্ট নারায়ে তাকবীর স্লোগানে মুখরিত হলো। মুজিবের এই ভূমিকা ভারত আদৌ মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের চক্রান্ত এগিয়ে চলল। শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঙালি মুসলমানদের বসতি গড়লেন। তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ৫ একর করে জমি বন্দোবস্ত দিলেন, যাতে এলাকায় মুসলিম প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অতঃপর সেখানে সেনাবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করলেন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করলেন। ১৯ দফা রচনা করে সারা দেশে ‘খাল কাটা’ বিপ্লব শুরু করলেন, যা ছিল আগ্রাসী ভারতের মরুকরণের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর সামান্য চেষ্টা মাত্র। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বঙ্গোপসাগর সফরে গেলেন ও ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওদের আগ্রাসন থেকে দেশ বাঁচানোর দায়িত্ব তোমাদের’। অবশেষে তিনি নিহত হলেন নির্মমভাবে।
কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি বলে জনগণের মধ্যে ভেদ রেখা টানা হয়। অথচ, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকায় পাকবাহিনী সারেন্ডার করে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানী হাজির ছিলেন না কেন? অথচ, তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হেলিকপ্টারে উড্ডয়ন করার কিছুক্ষণ পর একটি ভারতীয় সামরিক বিমান এসে তার হেলিকপ্টারের তেল ট্যাঙ্কিতে গুলি করে। তখন ভাঙা ট্যাঙ্কি দিয়ে হু হু করে তেল পড়া বন্ধ করার জন্য ওসমানী ও সাথী ডা. জাফরুল্লাহ তাদের স্ব স্ব ওভার কোট খুলে পা দিয়ে ছিদ্রপথে চেপে ধরেন। ফলে কোনো রকমে হেলিকপ্টারটি সিলেটের মাটিতে অবতরণ করানো সম্ভব হয়। হেলিকপ্টারটি পড়তে দেখে লোকেরা ‘দুশমন’ ‘দুশমন’ বলে এগিয়ে আসে। তখন ওসমানী আগুনের ভেতর থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়েন ও নিজের পরিচয় দেন। ফলে তারা উদ্ধার পান। ওই সময় ছোটকালে আমরাও কলিকাতা থেকে ঢাকামুখী ভারতীয় প্লেন উড়ে যেতে দেখলে সেদিকে তাক করে ঢিল বা তীর-গুলি ছুঁড়ে মারতাম। এদেশের সাধারণ মানুষ কেউ ভারতের পক্ষে ছিল না। ফলে ’৭১ ছিল জালেমদের বিরুদ্ধে মজলুমদের উত্থানের একটি ঘটনা মাত্র, যা অবশ্যই ঘটত।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, মওলানা ভাসানী ‘খামোশ’ বলে ধমকদাতা, পশ্চিম পাকিস্তানি জালেম শাসকদের উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনে ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলে প্রথম স্বাধীনতার বীজ রোপণকারী নেতা। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে তিনি মালদহ-চাঁপাই সীমান্তবর্তী ‘কানসাট’ অভিমুখী বিশাল ফারাক্কা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
মওলানা ভাসানীকে ’৭১-এর ৯ মাসে ভারতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। স্বাধীনের পরেও তিনি ঢাকায় স্থান পাননি। তার লাশ দাফন হয় কর্মস্থল টাঙ্গাইলের ‘সন্তোষে’। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল খুলনার খালিশপুর থেকে ট্রেন বোঝাই করে ভারতের অস্ত্র লুটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ফলে তিনিই হন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি! অথচ, ১৯৭২ সালে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে উপচে পড়া বিশাল জনসভায় দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যাটারিবিহীন রেডিও যেমন অচল, চরিত্রহীন জাতি তেমন অচল। অতএব ছেলেরা! উচ্ছৃঙ্খলতা পরিহার করো’। সেদিন ভারতের তৈরি ‘রক্ষী বাহিনী’র ছত্রছায়ায় হাজার হাজার মুসলিম তরুণকে হত্যার দৃশ্য জাতি নীরবে অবলোকন করেছিল। খুলনার পাইকগাছা থানাধীন ‘কপিলমুনি হত্যাকাণ্ড’ ছিল তার অন্যতম। তরতাজা তরুণদের দাঁড় করিয়ে বাপ-ভাইদের সামনে রেখে তাদের বলা হয়, ‘বলো জয় বাংলা’। তারা বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ারে একে একে ঢলে পড়ল তারা। ২৬৫টি লাশে ভরে গেল ছোট্ট পুকুরটি।... বলা হয়ে থাকে যে, সারা দেশে এভাবে ৪০ হাজার তরুণকে হত্যা করা হয়। এদের বিচার চাওয়ার কেউ নেই। করারও কেউ নেই। কিন্তু আল্লাহ সবই দেখেছেন। সেই সময়কার জালেমরা এখন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
কথায় কথায় বলা হয়, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কে গণনা করল? ৩০ লাখকে সে সময়ের ৪৮ হাজার গ্রাম দিয়ে ভাগ করলে প্রতি গ্রামে ৬২.৫ জন নিহত হওয়া প্রয়োজন। অথচ এমন বহু গ্রাম রয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের কোনো শহীদ নেই। এমনকি এদেশে মোট ভোটার সংখ্যা কত! সেই বিষয়েও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো ‘আজিজ কমিশন’। আপিল বিভাগের বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২২ মে সিইসির দায়িত্ব নেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার এই বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। তারা এক কোটি ভুয়া ভোটার এবং ৩০০ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা পদে দলীয় চিহ্নিত ক্যাডারদের নিয়োগ দেয় বলে অভিযোগ করা হয়, যা কতটা সত্য নির্ণীত হয়নি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ শোর তোলে এবং এক পর্যায়ে ফখরুদ্দীন গং ক্ষমতায় আসেন। এ সরকার ৯০ দিনের স্থলে বিদায় নেয় প্রায় দু’বছর পর। ক্ষমতায় আসে হাসিনা সরকার। সাড়ে ১৫ বছর পর ৫ আগস্ট দিল্লির বিল্লি আগরতলা হয়ে দিল্লি পালালেন। ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন হলো। একেই বলে ‘আল্লাহ মার, দুনিয়ার বা’র’।
কিন্তু খেলা থামেনি। ‘র’-এর এজেন্টরা রাষ্ট্রের সকল ‘কী’ পয়েন্টে বসে আছে। অসময়ে বন্যা ও প্রতিদিন সীমান্ত হত্যা চলছে। রূপার চাকতির গোলাম রাজনীতিক নামাধারীরা ‘অ্যাকশন-অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘রক্তের বন্যায় ভোসে যাবে অন্যায়’ ইত্যাদি স্লোগানে আবার রাস্তা গরম করছে। দলবাজ রাজনীতির নাগিণী আবার ফণা তুলছে।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা তাদের পথের কাঁটা। অথচ, এটাই হলো জাতির প্রত্যাশা। অন্তর্বর্তীকালীন বর্তমান সরকার যার প্রতিনিধিত্ব করছে। দলীয় রাজনীতির কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ পুনরায় তাদের খোরাক চায় না। শোসিত-বঞ্চিত হতে চায় না। ইসলাম এরূপ রাজনীতি সমর্থন করে না। সেখানে ক্ষমতাসীনরা হবেন জনগণের খাদেম ও আল্লাহ গোলাম। আল্লাহ আনুগত্যের অধীনে সকল নাগরিকের অধিকার হবে সমান। আল্লাহ সৃষ্ট সূর্য-চন্দ্র, নদী ও বায়ু যেমন সবার জন্য কল্যাণকর, ইসলামের আইন ও বিধান তেমনি সকল নাগরিকের জন্য কল্যাণকর। তাই এদেশের সংবিধান হবে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। এটাই হলো এদেশের জনগণের প্রাণের দাবি, ’৪৭-এর পর থেকে এযাবৎ কখনো যা পূরণ হয়নি। আল্লাহ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাজত করুন।
লেখক : আমীর, আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রফেসর (অব.) আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়