অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে কেউ যদি অন্যায়ের সাথে মিশে যায়, তবে তার জন্য কবি শ্রীজাত লেখেননি, ‘মানুষ থেকেই মানুষ আসে বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়, আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।’ কেউ দুর্নীতি করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিংবা ন্যায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়- সমাজের সাধারণরা এই অন্যায়-অনাচারে গা ভাসিয়ে দিলে সেই সমাজ থেকে আলো দূরে সরে যাবে। সবাই যদি বিনা প্রশ্নে অন্যায়ের সাথে আপস করে কিংবা বিনা বাধায় অপরাধকে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ দেয়, তবে সমাজ-সংসার কতদিন মানুষের বাসযোগ্য থাকবে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। অন্যায় যদি বিনা প্রতিরোধে শেকড়বাকড় বৃদ্ধি করতে পারে, তবে তা ভালো কাজের গতির চেয়ে কয়েকগুন শক্তি নিয়ে সমাজকে কলুষিত করে। অপরাধী যদি সমাজ থেকে প্রশ্রয় পায়, দুর্নীতিবাজদের যদি সুযোগ দেয়া হয় এবং সত্য অস্বীকারকারী যদি ক্ষমতা পায়, তবে সে সবকিছু গ্রাস করে মানুষের দুনিয়ায় প্রভুত্ব জাহির করতে চায়। তখন মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন হয় অপরাধীর অস্ত্র। মিথ্যার তলোয়ারে সে সবাইকে কুপোকাত করতে চায়।
দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর কিংবা লুটেরাকে সমাজ যখন বাধা না দেয়, তখন সে বেপরোয়া হয়। ক্ষমতা এবং অর্থের লোভ মানুষকে অন্ধ বানালে দুনিয়ার এহেন দুর্নীতি নেই, যাতে সে নিজেকে জড়াতে না পারে। তখন সে দখল করে সুখ পায়, অন্যায় করে জনপ্রিয়তা ছড়ায়। মানুষের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে, মানুষকে শাসিয়ে কিংবা মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে মিথ্যার যে বেসাতিতে নিজেকে রাজা বানায় সেখানে ন্যায়ের চিহ্নের লেশমাত্র থাকে না। মানুষের জন্য দরদ কিংবা মানুষের অধিকার বাঁচে না। সে রাষ্ট্রের সম্পদ তছরুপ করে এবং দুর্বলকে পিষে মারে। ক্ষমতার কালে নানাভাবে মানুষকে ত্যক্ত-বিরক্ত করতেও দ্বিধা করে না। অন্যায়কারী যখন মনে করতে শুরু করে সব তার, সবাই তাকে মানতে বাধ্য কিংবা তার ইচ্ছাতেই সবকিছু ঘটে, তখন সে দুনিয়ায় সর্বোচ্চ স্বৈরাচার হিসেবে প্রকাশিত হয়। খুন-জখম, হয়রানি-দখল এসব তার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় মনে হয়। দুর্নীতিবাজের সাম্রাজ্য মানুষের বসবাস নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে। সমাজস্থরা প্রশ্রয় দিতে দিতে, অন্যায় মানতে মানতে কিংবা চুপ থাকতে থাকতে জনতার ভোটে জয়ী সেবক দানবের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রত্যেক নীতিবান মানুষের উচিত সর্বশক্তি সহযোগে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। অন্যায় বন্ধে শক্তি প্রয়োগ করা। যদি অপরাধ সংঘটনকারী শক্তিমান হয় তবে প্রতিবাদ জানাতে হবে। বলে ও লিখে ভিন্নমত প্রকাশ করতে হবে। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তবে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে হবে। ইসলামে উপর্যুক্ত তিন স্তরের প্রতিকারের প্রেসক্রিপশনের কথা বলা আছে। দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের, সুদখোর ও জবরদখলকারীকে বিনাবাক্যে কিংবা বিনা বাধায় ছেড়ে দেয়া যাবে না। কোনো অপরাধকারী প্রকাশ্যে অপরাধ করার পরেও যদি সমাজ থেকে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তবে সেই অন্যায়ের দায় সবার ওপরে বর্তায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ন্যায়দণ্ড কবিতায় লিখেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তবে ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।‘ হাদিসে এসেছে, ঘুষদাতা এবং ঘুষগ্রহীতাণ্ড উভয়ই জাহান্নামে পতিত হবে। সুতরাং বিবেক এবং ধর্মে প্রমাণিত যে, শুধু অপরাধ সংঘটনকারী নয় বরং অপরাধের ইন্ধনদাতা, অপরাধকে প্রশ্রয়দাতাণ্ড কারোরই পার পাওয়া মুশকিল। পারলৌকিক বিশ্বাস যাদের অটুট তারা মানে কোন অপরাধ দণ্ডহীন যাবে না। তবে দুনিয়াতেও অন্যায়ের শাস্তি সামান্য হলেও প্রকাশ হতে হবে এবং তা মানুষের প্রতিরোধ-প্রতিবাদেই প্রকাশ্যে আসবে। ক্ষমতায় থাকার কালে একজন অপরাধীর সাথে শক্তিতে পারা না গেলেও মনে রাখতে হবে কারো ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয় না। যে যতটুকু অপরাধ করেছে তাকে ততটুকু লজ্জায় দুনিয়াতেই ফেলতে হবে। একজন দুর্নীতিবাজ আমলা, ঘুষখোর পুলিশ কিংবা নীতিহীন শিক্ষককে সর্ব সম্মুখে সুযোগ পেলেই অতীতের কার্যকলাপ মনে করিয়ে দিতে হবে। দুর্নীতিবাজের কণ্ঠ যাতে উঁচু না হয়, ঘুষখোরের মস্তক যাতে দেমাগ দেখাতে না পারে কিংবা দখলবাজ যাতে সমাজে সম্মান না পায়- সে ব্যবস্থাটুকু করতে হবে। কে কী কাজ করে, তার জ্ঞাত আয় কত- এসব এই সমাজের মানুষ ধারণা করতে পারে। কাজেই আয়ের সাথে যার সম্পদ অসামঞ্জস্য তাকে পদে পদে হেনস্তা না করলো অন্যায় ধারাবাহিক হওয়ার সাহস পাবে। যে অন্যায় করেছে তাকে যদি চেপে ধরকদা নয় হয়, তবে সমাজের আরো অনেকেই অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। অপরাধ ভয়ানকভাবে সংক্রামক। সম্পদ মানুষকে লোভী বানায়, ক্ষমতা মানুষকে প্রভূ বানায়। মুকুলে সমাধান করা না গেলেও পরিণত সময়ে নাড়া মুড়ো করে দিতেই হবে। অন্তত এই বার্তা স্পষ্ট হোক- দুর্নীতিবাজ সে আত্মীয় হলেও প্রত্যাখ্যাত। সমাজে কারা কত দুর্নীতি করে, কাদের অন্যায়ের সাথে দোস্তি কিংবা কোনো মহল নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের স্বার্থ বিক্রি করে তা স্পষ্ট। তাদের সাথে সাধারণরা শক্তিতে না পারলেও অসাধারণ কৌশলে পারবে। যারা নীতিহীন তারা নৈতিক সাহসে দুর্বল হয়। তাদের মধ্যে ভয় থাকে। হামভরা হাবভাবে তারা নিজেকে আড়াল করতে চায়। তারা সমাজের মোড়ল হিসেবে নিজেদের জাহির করে। কণ্ঠস্বরের তেজ দেখিয়ে মানুষকে ভয় দেখাতে চায়; কিন্তু তারা কুলিয়ে ওঠে না। যখন তারা অবসরে যাবে তখন দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোর বলে ডাকাডাকি করলেও অন্যায়-দুঃশাসনের চর্চা অনেকটা স্তিমিত হবে। যে মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করেছে, রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেছে কিংবা নাগরিক সেবা নিশ্চিত করেনি- তারা পরিত্যাজ্য হোক। অসম্মান তাদের বরাত। চোর চোর বলে যতদিনে তাদের বয়কট করা না যাবে, ততদিন এই সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধরাবে না। সিস্টেমের মধ্যেও যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিস্টেম চালু রেখেছে তারা বাংলাদেশের সংস্কার-প্রগতিতে বাধা। সমাজ-সংসারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তর থেকে দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরকে চিহ্নিত করে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে- জনগণ তাদের ঘৃণা করে। অন্যায়-অপদখলের বিরুদ্ধে যতদিনে সামাজিক আন্দোলন বেগবান না হবে, ততদিনে কিছুই পাল্টাবে না। আপনি পাল্টানোর আগে আমি না পাল্টালে দুধ দিয়ে রাজার পুকুর ভরার গল্পের মতোই রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন পরনির্ভর অবাস্তব থেকে যাবে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।