কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাননির্ভর করে শিক্ষকের মানের ওপর, তার দক্ষতা, যোগ্যতা, সম্মান ও মর্যাদার ওপর। আরো সোজা কথায়, শিক্ষার মান শিক্ষকের মানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবণতা হচ্ছে শিক্ষককে উপেক্ষা করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের প্রচেষ্টা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোথাও শিক্ষকের কণ্ঠস্বরকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। বরং শিক্ষকের কণ্ঠস্বরকে চেপে রাখতে নানামাত্রিক আধিপাত্য ও খবরদারিত্ব খুবই সক্রিয়। শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এই যে, শিক্ষার ঘরের চাবি পরের হাতে, অন্তত শিক্ষকের হাতে তো নয়ই! সরকারের প্রশাসন যন্ত্র থেকে শুরু করে নানা পরিচালনা পর্ষদ, গভর্নিং বডি, লেজুড়ভিত্তিক নামধারী ছাত্র সংগঠন সবাই মিলে শিক্ষক সমাজকে অধীনে রাখতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বাংলা ভাষায় ‘শিক্ষা’ শব্দটির কিছু বিপরীত ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহার রয়েছে। যেমন ‘উচিত শিক্ষা’, ‘হাড়ে হাড়ে শিক্ষা’, ‘জনমের শিক্ষা’, এমনকি ‘বাপের নাম ভুলানো শিক্ষা’ও রয়েছে। একজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে শুধু শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করেন, তখন শিক্ষাব্যবস্থার অন্য সকল নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত যেন শিক্ষককে এই নিদারুণ উচিত শিক্ষা দিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। প্রশাসন শিক্ষকে পা ধরিয়ে প্রশান্তি লাভ করেন, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পর্ষদ শিক্ষককে অধীনস্ত ভৃত্য হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন, শিক্ষার্থীরাও মাঝে মাঝে তার শিক্ষকেকে অপমানিত করে, চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে অথবা মাথায় বিষ্ঠা নিক্ষেপ করে বিকৃত আনন্দ খুঁজে পায়। সর্বক্ষেত্রে শিক্ষক যে ধোয়া তুলসী পাতা তা নয়, তবে শিক্ষককে নিয়ন্ত্রণ করবার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মধ্যেই উচিত শিক্ষার বিষয়টি লুকিয়ে আছে। তাছাড়া শিক্ষার সার্বজনীন চাওয়ার সাথে আমাদের রাষ্ট্রের চাওয়ার একটা সুক্ষ্ম; কিন্তু তাৎপর্যময় পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষা চায় নাগরিকের মুক্তি আর রাষ্ট্র চায় তার নাগরিকের আনুগত্য। মুক্তি আর আনুগত্যের পথ ভিন্ন। শিক্ষার উদ্দেশ্য মুক্তি হলেও শিক্ষার কারিগররা রুদ্ধ। ফলে একজন অবরুদ্ধ বা অধীনস্ত শিক্ষকের হাতে শিক্ষার মুক্তি সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকেদের জন্য একটি প্রচলিত সামাজিক সান্ত¡না আছে যে, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। এটি খুব প্রচলিত একটি শ্রুতিমধুর প্রবোধবাক্য, অনেকটা সাজপ্রিয় মেয়ের প্রসাধনীর মতো। যে প্রসাধনীর নীচে শিক্ষকের অসহায়ত্বের আসল অবয়বটি ঢেকে রেখে শিক্ষককে সান্ত¡না দেয়া হয়। আমাদের সমাজ শিক্ষকেদের নিয়ে বাহ্যিক কথাবার্তায় হৃদয়বান হলেও অন্তর্গত আচরণে হৃদয়হীন। বস্তুগত উন্নতির আড়ালে আমাদের মানবিক অবক্ষয় হয়েছে প্রবলভাবে। শিক্ষার আত্মিক উন্নতিকে উপেক্ষা করে বস্তুগত গড়ন-পাঠন নিয়েই সবাই ব্যস্ত। শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মান উন্নয়নের কথা বলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দশকের পর দশক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উঁচু উঁচু দালান, ক্লাসে ক্লাসে মাল্টিমিডিয়া, ই-কনেটেন্ট, কম্পিউটার ল্যাব ইত্যাদি করার জন্য উচ্চমহল যতটা উৎসাহী, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না শিক্ষকদের মূল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানবিকতার প্রশ্নে স্থানচ্যুত হয়ে পড়ছে। শিক্ষায় আজকাল যা শোখনো হয় তা স্বার্থপরতাই। বর্তমান শিক্ষা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করছে। এ শিক্ষা কেবলই প্ররোচনা দিতে থাকে তুমি একাই বড় হও, অন্যের ভালোমন্দের দিকে তুমি তাকিও না। ফলে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা প্রসারিত হচ্ছে। তাতে দিনকে দিন শিক্ষকের পাশাপাশি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই একটি ‘লিপিস্টিক ডেভেলপমেন্ট’-এর তলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সভ্যতার ইতিহাস ও অগ্রগতিতে শিক্ষা, শিক্ষাদান ও শিক্ষকতা খুব প্রাথমিক উপাদান। তবে শিক্ষার আলোচনাটি সভ্যতার সমান বয়সী হলেও শিক্ষকের স্বীকৃতির বিষয়টির আলোচনা খুব সাম্প্রতিক। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি এবং তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে তিন দশক আগে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তখন থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের মর্যাদা ও সক্ষমতার দীর্ঘদিনের যে দৈন্য তা সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সূত্রপাত। প্রতিবছরই দিবসটির প্রতিপাদ্যে শিক্ষকের মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শিক্ষার জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে শিক্ষকের কণ্ঠকে মূল্যায়ন’। প্রতিপাদ্যটি শিক্ষার ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং শিক্ষানীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জরুরি প্রয়োজনের ওপর ফোকাস করছে।
ইউনেস্কোর মতে, শ্রেণিকক্ষের ভেতরের সাথে শ্রেণিকক্ষের বাইরের একটি সম্পর্ক বিনির্মাণের জন্য শিক্ষার সাথে জন্য শিক্ষকদের সাথে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রয়োজন। যেখানে শিক্ষার সকল অংশীদার যেমন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সরকার, শিক্ষক সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী, কর্মসংস্থান এজেন্সি, সুশীল সমাজ এবং সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষকদের পরামর্শ এবং সামাজিক সংলাপে গুরুত্ব পাবে। সফলভাবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সামাজিক সংলাপ কাঠামো এবং প্রক্রিয়াগুলোতে শিক্ষকদের কণ্ঠস্বরকেই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষকদের কণ্ঠকে উপেক্ষা করলে শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মর্যাদা উভয় ক্ষেেেত্রই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর যে পাত্তা পায় না তা শুরুতেই বলেছি। শিক্ষকের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করার নানা কৌশল আমাদের দেশে খুব কার্যকর। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই একটি ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির বীজ বপন করে রাখা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কখনো সরাসরি গভর্নিং বডির মাধ্যমে, কখনো এনটিআরসিএর মাধ্যমে কখনো পিএসসির ননক্যাডার থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। কলেজ পর্যায়েও কোথাও বিসিএস, কোথাও আত্মীকৃত, কোথাও জাতীয়করণকৃত আবার কোথাও এনটিআরসিএ। সম্মান ও সম্মানীতে বিভক্ত এই শিক্ষক সমাজকে মর্যাদার লড়াইয়ে ব্যস্ত রেখে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের ওপর তাদের শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখে। শিক্ষকসমাজও তাদের কণ্ঠস্বর বা আওয়াজের বড় অংশটিই নিজেদের দ্বান্দ্বিক লড়াইয়ে খরচ করে ফেলেন। একজন শিক্ষককে যখন গবেষণা ও জ্ঞানসাধনায় নিজেকে ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকার কথা তখন তাকে মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে রাজপথে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে শিক্ষার নীতি ও পদ্ধতির যেখানে শিক্ষকের কণ্ঠস্বর জোরালো থাকার কথা সেই মূল জায়গায় দম হারিয়ে ফেলেন তারা। যে সমাজ শিক্ষককে দীনহীন ও করুণার পাত্র করে রাখে, বুঝতে হবে সে সমাজ তার মেরুদণ্ডকে সমুন্নত রাখতে ইচ্ছুক নয়।
শিক্ষকদের এই দুরবস্থা ও দুর্গতির জন্য শিক্ষকরা নিজেরাও কম দায়ী নন। সম্মান বা মর্যাদা আদায়ে কাঙালিপনা নয়, সম্মোহনের মাধ্যমে ব্রতচারী শিক্ষকতার সম্মানটি অর্জনের বিষয়। সামাজিক মর্যাদা প্রত্যাশার আগে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা যে জরুরি তা অনেকেই বেমালুম ভুলে যান। শিক্ষকের রাজনৈতিকচর্চা জ্ঞানচর্চাকে ছাপিয়ে গেলে শিক্ষকসত্তা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর শিক্ষকায় যদি লেজুড়ভিত্তিক চামচাচর্চার সক্রমণ ঘটে তবে শিক্ষকসত্তার মৃত্যু অনিবার্য। শিক্ষকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের বদলে স্বভাব তাঁবেদারিত্ব গুরুতর হয়ে উঠেছে। ভাবমূর্তি হারানো শিক্ষকের না আছে আগের মতো ভাব না আছে আগের সেই মূর্তি। ব্যক্তিচর্চা বা লেজুড়চর্চা শিক্ষকের কাজ নয়। ব্যক্তির পালনও শিক্ষকের কাজ নয়, শিক্ষকের কাজ ব্যক্তিত্বের লালন করা। শিক্ষকের প্রথম দায়িত্ব উপযুক্ত শিক্ষক হয়ে ওঠা। কেউ শিক্ষক হয়ে জন্মান না, শিক্ষক হতে হয় অন্তর্গত অন্বেষা, তাগিদ, অনুশীলন এবং পেশাগত দায়িত্বপালনের ভেতর দিয়েই। আমলা, আইনশৃঙ্খলা, বিচারক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, শিল্পী-সাহিত্যিক, যে পেশার কথাই ধরি না কেন, শিক্ষকতা হচ্ছে সর্বাধিক পরিমানে সামাজিক ও সংবেদনশীল। শিক্ষকের সাথে চিকিৎসকের কিছু মিল আছে, কিন্তু সেখানেও গুরুতর পার্থক্য হচ্ছে চিকিৎসক অসুস্থকে সুস্থ করার ব্রত নিয়ে কাজ করেন আর শিক্ষক সুস্থকে সুস্থ করতে কাজ করেন। অসুস্থকে সুস্থ করে তোলার কাজটি কঠিন কিন্তু আরও কঠিন সুস্থকে সুস্থ করে তোলা। অন্য যে কোন পেশার চেয়ে শিক্ষকতা বেশি পরিতৃপ্তির কাজ, প্রেরণার কাজ, তরুণদের সাথে আনন্দময় সময় কাটানোর কাজ, সম্মানের কাজ। সুতরাং শিক্ষক সমাজের সাধনা হবে সব সময়ই সুন্দরের শপথে বলীয়ান থাকা। আমাদের দেশে বহুরকমের বিপ্লব ঘটেছে; কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে বিপ্লব, সামাজিক বিপ্লব, সেটি কখনো ঘটেনি। সমাজকাঠামোতে পরিবর্তন না ঘটলে শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে না, শিক্ষকের অবস্থারও পরিবর্তন হবে না। রাজশক্তির সদিচ্ছা না থাকলে শিক্ষকের সৃজনশীল ইচ্ছেশক্তি পরিস্ফুটিত হয় না। শিক্ষার মান আর শিক্ষকের সম্মান দুটো পারস্পরিক ও অবিচ্ছেদ্য। আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও মর্যাদা কাদের? আর যাদেরই হোক শিক্ষকদের নয়। শিক্ষককে তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন তাকে প্রতিষ্ঠা করা নেতৃত্ব ও মর্যাদার আসনে। শিক্ষা তো শুধু বিদ্যালয়ের ব্যপার নয়, ব্যাপার পুরো সমাজের, সুতরাং শিক্ষককে সামাজিক নেতৃত্ব ও মর্যাদার আসনে আনা বিশেষভাবে আবশ্যক।