স্থির পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতি

জুবাইর হোসেন

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী বা পাহাড়িদের বসবাস কবে থেকে সে নিয়ে বির্তক থাকতে পারে, তবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পূর্ব থেকেই রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কয়েকটি উপজাতির লোকজন বসবাস করত, এ ব্যপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। পাহাড়ে বাঙালিদের বসবাসের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। আদিবাসী বা উপজাতিরা বাঙালিদের সাথে মিলে মিশে থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশায় ব্যত্যয় ঘটল কখন? পাহাড়িরা নিজেদের অস্বিত্ব সংকট অনুভব করল কি না, বিষয়টা খতিয়ে দেখায় অবশ্যই প্রয়োজন আছে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এই স্লোগান কিংবা চাকমা রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন যে, পার্বত্য অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীরা বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করবে। কেবল এ দুটি বিষয়ে আলোকপাত করলে এটি স্পষ্ট হয় যে মুক্তিযুদ্ধের আগে কিংবা পরে পাহাড়িদের নিজস্ব পরিচয় ধরে রাখার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা যায়নি। পাহাড়িরা নিজেদের বাঙালি কখনোই মনে করে না। ফলস্বরূপ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং অন্যান্যরা ১৯৭৩ সালে সমস্ত উপজাতির একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। পিসিজেএসএস’র সশস্ত্র শাখা, শান্তিবাহিনী, সরকারি নীতি প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত হয়েছিল। শান্তিবাহিনী বাঙালি পুলিশ ও সৈন্য, সরকারি অফিস ও কর্মচারী এবং এই অঞ্চলের বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে নবনির্বাচিত প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নতুন দফা আলোচনা শুরু হয়। শান্তি চুক্তি চূড়ান্ত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয় এবং পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর, পিসিজেএসএস একটি মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহীরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়। ৫০ হাজারেরও বেশি বাস্তচ্যুত নাগরিকগণ তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এর পর সবাই ভেবে ছিলেন আগত দিনগুলোতে বিরোধ নিষ্পত্তি হবে। আদতে তা হয়নি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল বটে। তবে গোড়ায় যে সমস্যাটি ছিল সেটি অমীমাংসিতই থেকে যায়। মূল সমস্যার জায়গাটি হলো ভূমির মালিকানা। বাঙলিদের মালিকানায় যে পরিমাণ জমি ছিল তা পাহাড়িদের ছেড়ে দিতে রাজি না হওয়া অথবা পাহাড়িদের নিজস্ব মালিকানাধীন জমি বাঙালিদের সাথে ভাগাভাগি না করা। দুই পক্ষের দাবির পেছনে তাদের জোড়ালো যুক্তিও আছে। এর সাথে পাহাড়ে সেনাবাহিনী ক্যাম্প থাকা নিয়ে পাহড়িদের দীর্ঘদিনের আপত্তি তো আছেই।

কাজে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। সম্প্রতি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা কিংবা পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাঙলি শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি তারই সাক্ষ্য দেয়। কথা হচ্ছে এমনটি কি চলতে দেয়া যায়। এক বাক্যে উত্তর হলো, না এভাবে চলতে পারে না, চলতে দেয়া যায় না। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে দেশের দ্বায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার লক্ষ্যে দেশের ভেতর থেকে এবং বাহির থেকে বিভিন্ন চক্রান্ত চলছে। পাহাড়কে অশান্ত রাখা সেই চক্রান্তেরই অংশ ভাবলে, খুবি বেশি ভুল হবে কি? কাজেই পাহাড়ে স্থিতি বজায় রাখতে হলে পাহাড়ে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যকার ভূমি-বিরোধ নিরসন করেত হবে। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান যেন সেনা-শাসনের মতো না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেনাবাহিনী পাহাড়িদের আস্থার জায়গা হিসাবে বিবেচিত হতে হবে। তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীদের (বিশেষ করে কুকি চীন) আক্রমণ থেকে বাঙালি কিংবা সাধারণ পাহাড়িদের নিরাপত্তা দিবে। সর্বোপরি, পাহাড়ে সংকট মূলত একটি রাজনৈতিক সংকট; এর মীমাংসা হতে হবে রাজনৈতিকভাবেই।