ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়

গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৮ আগস্ট নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই পুরো বিশ্ব থেকে অভিনন্দন ও অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ফোকলা করে যাওয়া দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছেন। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোও বিপুল সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিপুল গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশের অর্থনীতি, কূটনীতির মতো জটিল বিষয়গুলো অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। তার অন্যতম নজির হচ্ছে, হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষে আরব আমিরাতের প্রবাসীরা আন্দোলন করতে গিয়ে দেশটির নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোয় ৫৭ জন যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশটির প্রেসিডেন্টকে ফোন করে তাদের মুক্ত করে দেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি নজিরবিহীনভাবে সকলকে মুক্ত করে দেন।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম যখন ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানান, তখন তিনি তাকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান। আনোয়ার ইব্রাহিম তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি গত শুক্রবার বাংলাদেশে সফরে আসেন। এর মধ্য দিয়ে বিগত এক দশকের মধ্যে মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রথম কোনো দেশের সরকার প্রধান সফরে এলেন এবং মালয়েশিয়ার সাথে উন্নত সম্পর্কের এক নতুন দ্বার খুলে গেছে। এটাও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ড. ইউনূসের কূটেনৈতিক সাফল্যের মুকুটে একের পর এক পালক যুক্ত হচ্ছে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম চার-পাঁচ ঘণ্টার জন্য ৫৮ সদস্যর প্রতিনিধিদল নিয়ে গত শুক্রবার দুপুর ২টায় বাংলাদেশ সফরে আসেন। বিমাবন্দরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে স্বাগত জানান। তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা, গান স্যালুট ও গার্ড অফ অনারের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। ড. ইউনূস এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে চার দশকের বেশি সময়ের বন্ধুত্ব। পুরোনো বন্ধুকে নিয়ে তিনি বিমানবন্দর থেকে একই গাড়িতে বৈঠকস্থল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যান। বৈঠকে তারা রাজনৈতিক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রোহিঙ্গা সংকটসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় গত ৩১ মে থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিক নেয়া বন্ধ থাকার বিষয় আলোচনা হয়। ওই সময়ের মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও হাসিনা সরকারের ব্যর্থতায় প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। এ নিয়ে তখন হাসিনা সরকার মালয়েশিয়াকে বহু অনুরোধ করেও এসব শ্রমিক পাঠাতে পারেনি।

বাংলাদেশে সফরে এসে আনোয়ার ইব্রাহিম এই ১৮ হাজার শ্রমিককে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা শ্রমিকরা যেমন আশান্বিত হয়েছে, তেমনি নতুন করে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠানো নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক চার এমপি ও মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠান এবং মালয়েশিয়ার ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সিন্ডিকেট পুরো শ্রমবাজারকে জিম্মি করে ফেললেও হাসিনা সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকার ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও এই সিন্ডিকেট সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। তারপরও অনেকে যেতে পারেনি। বলা বাহুল্য, শ্রমিকরা জীবনের শেষ সম্বল জমিজমা, ভিটেমাটি বিক্রি এবং ধারদেনা করে শুধু ভালোভাবে জীবনযাপন করার জন্য প্রবাসমুখী হয়। অথচ এই সিন্ডিকেটের কারণে সে পথ কঠিন হয়ে যায়। অনেকে মালয়েশিয়ায় গেলেও প্রতিশ্রুত কাজ পায়নি, কেউ প্রতারিত হয়ে যেতে পারেনি, পুরো অর্থও ফেরত পায়নি।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। এদের অনেকে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, আমাদের শ্রমিক দরকার এবং তাদের প্রতি যেন আধুনিক দাসের মতো আচরণ করা না হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে অতীতের পদ্ধতি আমরা ভেঙে দিয়েছি। এখন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগ হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া তথাকথিত সিলেক্টেড লোকদেরও মানতে হবে। তিনি বলেছেন, ১৮ হাজার বাংলাদেশি সব ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। যেতে না পারা তাদের দোষ নয়। এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় সমন্বয় করব। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য অত্যন্ত সুসংবাদ এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজার খুলে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। আশা করা যায়, অচিরেই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার পুনরায় চালু হবে। এই সাফল্য নিশ্চিতভাবেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার পতনের পর ড. ইউনূসের কারণে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সহজ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক পাঠানোর সিন্ডিকেটও এখন ভেঙে গেছে। তবে নতুন করে আবারও সিন্ডিকেট তৈরি হতে পারে। সিন্ডিকেট যাতে শ্রমবাজারকে কঠিন করে তুলতে না পারে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ভিসা সহজীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে প্রতারিত না হয়, এ ব্যাপারে সঠিক কর্মপন্থা এবং তাদের সচেতন ও সতর্ক করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণে বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং অর্থনীতি, কূটনীতি, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অফুরন্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত