শুধু আত্মত্যাগ নয়, সঠিক আন্দোলন চাই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একাত্তর সালটা বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য ছিল চরম দুর্দশার। পাকিস্তানি হানাদাররা হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। রাষ্ট্র তাদের লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাড়পত্র দিয়েছিল যা ইচ্ছা তা-ই করার। তারা সেটি করেছেও। রাষ্ট্রীয় সমর্থনে ক্ষমতাবান হয়ে হত্যা, অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ সমানে চালিয়েছে। এখন তো পাকিস্তান নেই, এখন তো আমরা স্বাধীন, বাঙালিই শাসন করছে বাঙালিকে। তাহলে এখন কেন মেয়েরা এভাবে নির্যাতিতা হচ্ছে? পাচার হচ্ছে ভারতে, জীবিকার অন্বেষণে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে যেখানে-সেখানে, আত্মহত্যা করছে যখন-তখন, আটকা পড়ছে বাল্যবিবাহের ফাঁদে? কারণটা আমাদের অজানা নয়।

কারণ হচ্ছে পাকিস্তান বিদায় হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ওই রাষ্ট্রের আদর্শ বিদায় হয়নি। বরং আরো প্রবলভাবে ফিরে এসেছে। আদর্শটা ছিল পুঁজিবাদী। সে আদর্শের এখন জয়জয়কার।

আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ব্যাপক। দুর্বল লাঞ্ছিত হচ্ছে, হতে থাকবে। কেননা, আমরা উন্নতি করতেই থাকব এবং অত্যন্ত অল্প কিছু মানুষের উন্নতি কাল হয়ে দাঁড়াবে বাদবাকিদের জন্য।

এটিই ঘটছে। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি, এমন কথা যারা বলেন, তারা মোটেই মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই প্রেতাত্মাটাকে চিহ্নিত করেন না। প্রেতাত্মাটা অন্য কিছু নয়, প্রেতাত্মাটা পুঁজিবাদ। আর প্রেতাত্মাই বলি কী করে, সে তো ভীষণভাবে জীবন্ত। সে তো ব্যস্ত জীবিতদের জীবন কেড়ে নেয়ার কাজে। ধর্মকে সে ব্যবহার করে উপায় ও আচ্ছাদন হিসেবে। না মেনে উপায় নেই যে আমাদের জাতীয়তাবাদীরা সবাই পুঁজিবাদী-পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের নামে মস্ত পার্থক্য, চরিত্রে মৌলিক পার্থক্য নেই। নেই মৌলবাদ তোষণেও।

তাহলে উপায় কী? প্রতিবাদ? অবশ্যই। বাল্যবিবাহে অসম্মত মেয়েরা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করছে, এমন খবর পাওয়া গিয়েছে।

কিশোরী মেয়েরা বিয়ের আসর থেকে সহপাঠিনীকে উদ্ধার করছে, আমরা জানতে পেরেছি। খবরের কাগজেই বের হয়েছে এমন খবর যে মাগুরায় এক মা তার মেয়েকে উত্ত্যক্তকারী যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন। কিন্তু তাতে তো ব্যবস্থাটা বদলায় না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ চলেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে দুজন আমেরিকান নিহত হয়েছিলেন, তাদের একজনের মা বলেছেন, তার ছেলে বীর ছিল, মৃত্যুর পরও বীর থাকবে।

মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে, সে চেষ্টা চলবে, কিন্তু মনুষ্যত্ব নষ্ট হওয়ার নয়, হবেও না। তবে একলা একলা প্রতিবাদ করে যে কাজ হবে না, সেটি তো প্রমাণিত সত্য।

তাহলে কি পালাতে হবে? কিন্তু পালাবেন কোথায়? একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে মানুষকে পালাতে হয়েছিল, ফিরে এসে তারা দেখেছে, এ কী পাকিস্তান তো রয়েই গেছে! বদলটা শুধু নামেই। মানুষ এখনো পালাচ্ছে।

ধনীরা এরই মধ্যে বিদেশে বাড়িঘর তৈরি করেছে, সময়মতো চলেও গেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় সংঘর্ষ থামানোর লক্ষ্যে দলীয় লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দল যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালানোর পথ পাওয়া যাবে না। এই সতর্কবাণী মিথ্যা ছিল কি? যারা পেরেছে, তারা তো এরই মধ্যে ব্যবস্থা করেছে, অন্যরাও তৎপর আছে। আর যাদের টাকা-পয়সার অভাব, দলের লোক নয়, সাধারণ মানুষ, তাদেরও একটা অংশ কিন্তু পালাচ্ছে।

রিপোর্টে বলছে, নৌপথে ইউরোপে যারা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে, তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিরা এখন শীর্ষস্থানে। হতভাগা এই মানুষরা অবশ্য টাকা পাচারের জন্য যায় না, টাকা উপার্জনের জন্যই যায়। কিন্তু যাচ্ছে তো। জীবন বাজি রেখে যাচ্ছে। ঝাঁপ দিচ্ছে সমুদ্রে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া থেকে মানুষ পালাবে, সেটি স্বাভাবিক, কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী এবং উন্নতিতে পুলকিত বাংলাদেশ থেকে অত মানুষ পালাচ্ছে কেন? পালাচ্ছে এখানে জীবিকার নিরাপত্তা নেই বলে এবং মেয়েদের দুরবস্থা বলছে, এখানে নিরাপত্তা নেই জীবনেরও।

সিদ্ধান্তটা তো তাই অপরিহার্য। করণীয় হচ্ছে পুঁজিবাদকে বিদায় করা। কিন্তু সে কাজ তো একা কেউ করতে পারবে না, করতে গেলে কেবল হতাশাই নয়, বিপদ বাড়বে।

বিদায় করার জন্য দরকার হবে আন্দোলন এবং আন্দোলনের জন্য চাই রাজনৈতিক দল। শুধু দলেও কুলাবে না, শত্রুকে যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয় এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল নেয়া না যায়। বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধটা শেষ হয়েছে, বাকি রয়েছে সমাজতন্ত্রের জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ যে সহজ হবে না, সেটি তো স্পষ্ট। জবরদস্ত পুঁজিবাদের দখলে অনেক অস্ত্র রয়েছে; খুবই শক্তিশালী একটি অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়া পুঁজিবাদের নৃশংসতার খবর ছিটাফোঁটা দেয়, কিন্তু আসল খবর দেয় না; ঢেকে রাখে, বিভ্রান্ত করে এবং নানা কিসিমের রূপকথা তৈরির কারখানা চালু রাখে।

মাদ্রাসা শিক্ষা বেকারত্ব বৃদ্ধির কারখানা বৈকি। এখন তো বোঝা যাচ্ছে দেশের মাদ্রাসাগুলো শুধু বেকার নয়, জঙ্গিও উৎপাদন করেছে। এ পর্যন্ত যত বোমাবাজির জঙ্গি ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় সবাই এসেছে মাদ্রাসা থেকেই। এ দেশের ধনীরা নিজেদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠাবে, এটি চিন্তা করলেও ভয়ে শিউরে উঠবে, কিন্তু তারা অবিরাম ও বর্ধমান গতিতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে কেবল যে উৎসাহিতই করছে তা নয়, নিজেরাও বিপুল উৎসাহে মাদ্রাসা খুলছে। একটি হিসাবে দেখলাম, গত ২০ বছরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে বেড়েছে তিন গুণ, সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বেড়েছে আট গুণ; ওদিকে বিজ্ঞানের ছাত্রের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। অধঃপতনের চিহ্ন কোনো এক জায়গায় আটকে নেই, সর্বত্র পরস্ফুটিত বটে। পুঁজিবাদীরা মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করে মানুষকে অন্ধকারে রাখার জন্য। সেই সঙ্গে আশা করে পরকালে পুণ্য হবে এবং ইহকালে ধার্মিক লোক হিসেবে মানুষের প্রশংসা লাভ করবে। এ শিক্ষা গরিবের সঙ্গে মস্ত একটা মসকরা বটে। মূর্তিমান ষড়যন্ত্রও।

ওদিকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লক লক করে বেড়ে চলেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার আকাশ-পাতাল ব্যবধান; একটি ‘সর্বাধুনিক’, অন্যটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। কিন্তু মিলও রয়েছে। মিলটা অন্তঃসারশূন্যতা ও কৃত্রিমতায় এবং সব দেশের প্রতি বিমুখতায়। ইংরেজি মাধ্যম তাকিয়ে থাকে দূর পশ্চিমের দিকে, মাদ্রাসার মুখ অত পশ্চিমে না গেলেও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা করে না। দুটির কোনোটিতেই নিজের দেশ প্রধান হয়ে ওঠে না। শিক্ষা হওয়া উচিত মাতৃভাষার মাধ্যমে; হওয়া দরকার অভিন্ন ধারার এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ওই তিন বিবেচনার কোনোটিতেই উত্তীর্ণ নয়। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাটা যে ত্রুটিমুক্ত, তা নয়। সেটিও অত্যন্ত দুর্বল, বলা যায় নড়বড়ে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই। কেননা, এই শিক্ষা তাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শিক্ষকরাও অমনোযোগী, বলেন তাদের বেতন কম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই শিক্ষাও পুঁজিবাদী মানুষ তৈরিতে নিয়োজিত। এখানেও লক্ষ্য থাকে শিক্ষার্থীকে জনবিচ্ছিন্ন স্বার্থপরতার আদর্শে দীক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত করার, আমরা নামছি। নামছি যে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে দেশপ্রেমের হ্রাসপ্রাপ্তি। কিন্তু আমরা তো নামতে চাই না, উঠতে চাই। সে ক্ষেত্রে করণীয়টা কী? প্রধান করণীয় হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করে তোলার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশের মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক, মূল আন্দোলনকেও তাই অতি অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে।

সামাজিক আন্দোলন এবং সংস্কার তৎপরতার অবশ্যই মূল্য রয়েছে; কিন্তু শুধু তাদের ওপর নির্ভর করলে আগামী ১০০ বছরেও আমরা মুক্তি অর্জন করতে পারব না। নদীর সঙ্গে অনেক খাল যুক্ত থাকে, কিন্তু খাল নদী সৃষ্টি করে না; নদীতে যদি প্রবাহ না থাকে, তাহলে খালই বরং শুকিয়ে যায়, স্মারক হিসেবে ডোবায়ও পরিণত হতে পারে। কিন্তু কোনো রাজনীতির কথা ভাবছি আমরা? অবশ্যই শাসক শ্রেণির রাজনীতি নয়। শাসক শ্রেণির রাজনীতি হচ্ছে লুণ্ঠনের এই শ্রেণির সদস্যদের ভেতরকার মারামারি, কাটাকাটিটা খুবই স্বাভাবিক, লুণ্ঠনকারীরা কবে একত্র থাকে? কিন্তু ওই রাজনীতি জনগণের অপকার ছাড়া উপকার করবে না। সরকার বৈধ হোক কি অবৈধ হোক, তাতে বঞ্চিত মানুষের তেমন কিছু যায় আসে না এবং বৈধ-অবৈধ নির্বাচনে যে-ই জিতুক, জনগণের যুক্তির বিবেচনায় তা একেবারেই অর্থহীন ও অপচয়মূলক। এই দলের হাতে পীড়িত হবে, নাকি অপর দলের-এটি ঠিক করে দেয়ার বাইরে নির্বাচনের অন্য কোনো ভূমিকা যে নেই, তা প্রতিটি নির্বাচনই বর্ধিত হারে প্রমাণ করে দিয়ে যাচ্ছে।

যে আন্দোলনের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই আন্দোলনকে বেগবান ও গভীর করা চাই। এ আন্দোলন চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদবিরোধী। এর জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমের। কেবল দেশপ্রেমে কুলাবে না; দরকার হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের। এর জন্য সংগঠন চাই, যেখানে বিবেকবান মানুষরা থাকবেন, থাকবেন বুদ্ধিমান মানুষরাও অর্থাৎ তারা, যারা জানেন যে ব্যক্তির মুক্তি সমষ্টির মুক্তির ভেতরই প্রোথিত রয়েছে। অভ্যুদয়ের পথ ওটাই। তার বাইরে অন্য সব তৎপরতা মূল্যহীন নয়। কিন্তু তারা ওই খালের মতোই অত্যন্ত উপকারী হবে, যদি নদী থাকে প্রবাহমান। নদীর কোনো বিকল্প নেই। শুধু আত্মত্যাগে হবে না, সঠিক আন্দোলন চাই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়