অন্তর্বর্তী সরকারের দু’মাসে সাফল্য অনেক। একই সঙ্গে অপরিহার্য গণপ্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার হতাশাও আছে। সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে সব কিছুই ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছে, জঞ্জালের স্তূপ তৈরি হয়েছে সর্বত্র। ভাঙাচোরা প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি সচল করা, জঞ্জাল সাফ করা খুব সহজ কাজ নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তরিকতার সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সাফল্য যা কিছু তার প্রায় সবই তার কারণে। উপদেষ্টা পরিষদে আর যারা আছেন, তাদের অনেকেই যোগ্য, অভিজ্ঞ ও দক্ষ। দু’চারজন আছেন, যাদের নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দু’মাসের মধ্যেও প্রশাসন গতি পায়নি। সেজন্য প্রশাসন সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার দায় বা ব্যর্থতা এড়াতে পারেন না। এখনো বিচার বিভাগ বিন্যাস্ত করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক, উদ্দেশ্যমূলক ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার হয়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনেক মামলা ঝুলে আছে। আরো অনেকের মামলাও ঝুলে আছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেয়া এসব মামলা প্রত্যাহার কি এতই কঠিন?
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল কী করছেন? তার, আলী ইমাম মজুমদার ও আরো দু’একজন উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ করা হয়েছে, তারা তাদের কাজ ও ভূমিকার মাধ্যমে পতিত স্বৈরাচারের উপকার বা সহায়তা করছেন। স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসন করছেন বা পুনর্বাসনের পক্ষে কাজ করছেন। এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। বলা বাহুল্য, কয়েকজন উপদেষ্টার আচরণ, ভূমিকা, অকর্মন্যতা ও ব্যর্থতা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাদেরই কল্যাণে প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের দোসররা বহাল তবিয়তে আছে। তারা সরকারের বিপক্ষে কাজ করছে। গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির সংলাপে বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধীরা সরকারে কেন? ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষাবিরোধী, যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত রয়েছে, তাদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানানো হয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, স্বৈরাচারের দোসরদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য অর্জন ও ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কখনই সম্ভব নয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির সংলাপে সংগত কারণেই নির্বাচনের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। বিএনপির তরফে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে এও বিএনপি জানিয়েছে, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সর্বত্র স্বৈরাচারের দোসররা সক্রিয় থাকায় গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের মধ্যেও এমন দুয়েকজন আছেন যারা এই চেতনাবিরোধী কাজ করছেন। সংলাপে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ছাড়াও বিএনপি নির্বাচন কমিশন সংস্কার, কমিশন নিয়োগের আইন বাতিল, বিগত তিনটি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা কমিশনারদের আইনের আওতায় আনা, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রশাসনে আওয়ামী দোসরদের অপসারণ, ২০০৭ সালে থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়ের করা সকল রাজনৈতিক, গায়েবি ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, ভারতে বসে হাসিনার অপপ্রচার বন্ধে ভারতের সঙ্গে আলোচনা, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা গ্রহণ, গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা ইত্যাদি দাবি জানিয়েছে। দাবিগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচনই তার সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। বিগত তিনটি নির্বাচন কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ওই তিনটি নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে পারেনি। ভোটাধিকারবিহীন নির্বাচন নির্বাচন পদবাচ্য হতে পারে না। নির্বাচন-প্রহসনের জন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ প্রভৃতিই দায়ী। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যৌক্তিক সংস্কার অত্যাবশ্যক। এরই মধ্যে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলো : জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন ও সংবিধান। তিন মাস সময় দেয়া হয়েছে কমিশনগুলোকে। এরপর কমিশনগুলোর প্রস্তাব বা সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হবে। তারপর চূড়ান্ত হবে সংস্কার কর্মসূচি। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় যতটা সময় লাগবে, তা রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে হবে। ইতোমধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে সম্মত হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রম চলার সময় সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব সব ক্ষেত্রে থেকে স্বৈরাচারের দোসর, ভারতের কেনা গোলামদের বিদায় করে দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, জননিরাপত্তা জোরদার, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, যাতায়াত নির্বিঘ্ন করাসহ সেবামূলক কাজে অধিক জোর দিতে হবে। স্বৈরাচারের অংশীজন ও দোসরদের গ্রেফতার, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজে যথেষ্ট গড়িমসি প্রত্যক্ষ করছেন পর্যবেক্ষকরা। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন ভারতে, সেটা সবাই জানে। শতাধিক আওয়ামী নেতা-মন্ত্রীও ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে বলা হচ্ছে। তারা কীভাবে পালালেন এটা একটা বড় জিজ্ঞাসা। যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ও গণঅভ্যুত্থানের সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে সেইসব ঘাতক কোথায়? এখনো তাদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা হয়নি কেন? এ ধরনের নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে উঠছে। একইভাবে সামরিক বাহিনীর মধ্যে যারা দুর্নীতিবাজ, খুনের দোসর, আয়নাঘরের হোতা, গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নায়ক, তারা অধরা আছে কেন, এমন প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। গত শনিবার রাজধানীর মহাখালিস্থ রাওয়া কনভেনশন হলে ‘বৈষম্যমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ২.০ বির্নিমাণে প্রয়োজনীয় রূপরেখা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু’জন সমন্বয়কও অংশ নেন। সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক কারণে সশস্ত্রবাহিনীর যারা চাকরিচ্যুতির শিকার হয়েছেন, তাদের পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর যারা পিলখানা হত্যাকা- ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কিংবা তাতে সহযোগিতা করেছে তারা অধরা থাকতে পারে না। উল্লেখ করা হয়েছে, তারিক সিদ্দিকি ও জিয়াউল আহসানের পাশাপাশি অনেক সেনা কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। আয়নাঘরের প্রসঙ্গে বলা হয়, মামুন খালেদ ও জিয়াউল আহসান আয়নাঘর তৈরিতে জড়িত। স্বৈরাচারের পক্ষে সশস্ত্রবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা খুন, গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি শুধু সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের নয়, গোটা দেশবাসীর দাবি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানকে দায়িত্ব দিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের চিহ্নিত ও বিচারের আওতায় আনা এ মূহূর্তে একটি বড় কাজ। সেনাবাহিনীকে স্বৈরাচারের প্রভাবমুক্ত করার কাজে সেনাপ্রধানকে সফল হতে হবে। কারণ, এর ওপর সশস্ত্রবাহিনীর মর্যাদা, সম্মান ও গণআস্থানির্ভর করে। সেনাপ্রধানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির দিকেও তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থির করার একটি দেশি-বিদেশি চক্রান্ত এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেশের শান্তি-সংহতি সুরক্ষায় তাকে অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের রাজনীতি নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে কিংবা অন্যকিছু নিয়ে ভাবনার জন্য সরকার আছে, রাজনীতিকরা আছেন। তার যা কাজ, সেটুকু করলেই যথেষ্ট। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, এরই মধ্যে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সামনে রেখে আমাদের পথচলা নির্বাধ হোক, মসৃণ হোক, এটাই কাম্য।