বিগত কয়েক বছর ধরে হাওরে শুধু নয়, সারা দেশেই কৃষিকাজে শ্রমিক সংকট কিংবা কৃষিকাজের প্রতি অনীহার কথা আমরা শুনছি। এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে নানা আলোচনার কথা আমি জানি। জানি বলছি এ কারণে যে, সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত কয়েকজনের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন।
একজন শিক্ষক হলেও গ্রামে আমাদের জমিতে ধান হতো, বাবা সরাসরি সেগুলো তদারকি করতেন। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি আমি, যে দুয়েকটা স্মৃতি মাঝে মাঝে মনে পড়ে এর একটা হলো বাবার সাথে খেতের আইল ধরে হাঁটা। জানি না কেন, শিক্ষক এবং কৃষকদের প্রতি আমার আলাদা এক টান আমি সবসময় টের পাই। আর বলতে কষ্ট হচ্ছে, এই দুই শ্রেণির মানুষগুলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলেও মোটা দাগে অবহেলা তারাই বেশি পান। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ড থাকে কই? পেছনে। শিক্ষার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষের অবস্থানও কেমন করে জানি আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় পেছনে রাখা হয়। আর কৃষক তো এখনো একটা অভিযোগ বা আবেদন নিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসে যাবারও সাহস করে উঠতে পারেননি। তারা তাদের টাকায় বেতনে রাখা মানুষদের সাথে দেখা করতেও স্থানীয় নেতা বা এরকম কাউকে সাথে নিয়ে যান। কৃষকরা তাদের মর্যাদা হয়তো নিজেরাই বুঝেন না। এই অবস্থা কি একদিনে তৈরি হয়েছে?
অথচ সভ্যতার শুরু কিন্তু কৃষকদের হাত ধরেই। ইতিহাস বলে, দশ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাগৈতিহাসিক কালের যাযাবর মানুষেরা দেখল, মাটিতে বীজ পুঁতলে তা থেকে চারা বের হয়। সেই চারা বড় হয়। আর এটা দেখেই তারা সিদ্ধান্ত নিল এক জায়গায় থিতু হওয়ার। সেই থেকে কৃষিকাজের উদ্দেশে এক জায়গায় থাকতে শুরু করে আদিম মানুষ। তারাই ছিল পৃথিবীর প্রথম কৃষিজীবী। আর তাদের মাধ্যমেই সভ্যতার সূচনা পর্বের পত্তন হয়। যখন মানুষ কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিল এবং নিয়মিতভাবে খাদ্যশস্য ফলাতে শুরু করল, তখনই আসলে প্রকৃত সভ্য সমাজ তৈরি হতে লাগল। আমরা অনেকেই জানি যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের কৃষকদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে না পাঠিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য। শুধু কবিপুত্র নয়, তিনি তার জামাতা ও এক বন্ধুপুত্রকেও পাঠিয়েছিলেন। কবি বিশ্বাস করতেন, প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষকের এ উপমহাদেশের প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন। তিনি বলতেন, ভারতীয়দের অক্সফোর্ডে উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে ইলিনয়তে উন্নত কৃষক হওয়ার শিক্ষাগ্রহণ করা প্রয়োজন।
সহজেই অনুমান করা যায়, কত আগেই কবিগুরু এদেশের কৃষক ও কৃষি নিয়ে ভেবেছেন, যার প্রয়োজন এখনো আমাদের মনে এখনো জাগেনি! এমনকি রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিপদ্ধতি প্রবর্তনে কলের লাঙল ব্যবহারের কথা বলেছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য পতিসরে সাতটি বিদেশি কলের লাঙল আনেন কলকাতা থেকে। আমেরিকা থেকে কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি শেষে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ পতিসরে আসেন; ক্ষেতে ট্রাক্টর চালান; আধুনিক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠায় কৃষকদের উৎসাহী করেন। রথির কৃষি খামার দেখে নিউইয়র্ক থেকে আসা এক আইনবিদ মাইরন ফেলপস এতটাই অবাক হয়েছিলেন, তিনি একে মার্কিন কৃষি খামারের মতোই সফল এক উদ্যোগ বলে বর্ণনা করেছিলেন। (কৃষ্ণা কৃপালিণী, রবীন্দ্রনাথ ট্যাগর- অ্যা বায়োগ্রাফি, পৃ. ১৬৩)।
তৎকালীন সমাজে দরিদ্র কৃষকের অবস্থা বেশ শোচনীয় ছিল। কৃষি উৎপাদনের জন্য তাদের মূলধনের বেশ অভাব ছিল। সে সুযোগে সমাজের এক শ্রেণীর ধনী-মহাজনদের দাদন ব্যবসা ছিল রমরমা। তাদের এ মহাজনী চড়া সুদে কৃষকেরা সর্বশান্ত হতেন। তাদের কষ্ট কবিগুরু হৃদয় দিয়ে অনভব করেছেন। তিনি তার লেখা ‘দুই বিঘা জমি’-তে উপেন চরিত্র চিত্রায়নের মাধ্যমে মহাজনী শোষনের নিষ্ঠুর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সমব্যাথী হয়েছেন গ্রামের এসব দরিদ্র অসহায় কৃষদের সাথে। কবি পদ্মার পলি বিদৌত জনপদে কৃষিকে অবলকোন করেছেন হৃদয় দিয়ে। তার ‘সোনার তরী’ কবিতাটি শিলাইদহ অবস্থান কালীন বজারায় বসে লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সময়ের কৃষকের চেয়ে আজকের কৃষকের অবস্থা আরো অনেকখানি করুণ হয়েছে নানাভাবে।
এবার আসি মূল কথায়। হাওরের খাদ্য উৎপাদকরাই সুরক্ষিত রাখেন এ দেশের খাদ্য ও কৃষি। সচল রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু প্রতি বছর মার্চ মাস এলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাওরের বাঁধের আশপাশে অবস্থান নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটান হাওরের কৃষক। আগাম বন্যা, আকস্মিক বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, শিলাবৃষ্টি, কুয়াশা, বজ্রপাত, হট ইনজুরি, কোল্ড ইনজুরি, ধানে ছিটা, বীজ সমস্যা, কৃষি উপকরণের চড়া মূল্য, মানসম্মত বীজের অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াসহ নানাবিধ কারণে হাওর এলাকার কৃষকরা প্রতিনিয়তই ক্ষতির সম্মুখীন হন। এসব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গে নিয়েই কৃষকরা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবদান রেখে আসছেন। আমাদের সকলের জানা, হাওর অঞ্চলে বোরো মৌসুমের উৎপাদিত ধান দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ। হাওরের বোরো মৌসুমের ধানের ফলন বিপর্যয়ে শুধু তাই কৃষকের ক্ষতিই হয় না, একই সঙ্গে তা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাওর এলাকার কৃষি, কৃষকের জীবন, তাদের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো আলোচনার পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় কী হতে পারে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের ভাবা দরকার।
তথ্য বলছে, দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় সাত ভাগ হাওর। হাওরের জমি মূলত এক ফসলি এবং শুধু বোরো মৌসুমে ধানের চাষ হয়।
আবার কিছু জমি রয়েছে, যেখানে বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি অল্প পরিমাণে চাষ হয়। তবে মূল হাওরের জমি কিন্তু এক ফসলি। আর বোরো ধান ঘরে তোলা নির্ভর করে মূলত প্রকৃতির ওপর। হাওরাঞ্চলের বিরাজমান জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু হাওর অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখনও সেভাবে বিবেচনা করা হয়নি। হাওর অঞ্চলের কৃষি প্রতিবেশ, মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও এলাকা উপযোগী শস্য ফসল ও ফসলের জাতকে গুরুত্ব না দিয়ে রাসায়নিক তথা বাণিজ্যিক কৃষি প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, হাওরবাসী কৃষি-মৎস্যসহ হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহারের ভেতর দিয়েই এককালে গড়ে তুলেছিলেন স্বনির্ভর হাওর জীবন। হাওর জনপদের মানুষের সেই সার্বভৌমত্বের হাওর জীবন আজ নানাভাবে বিপন্নপ্রায়। জলাভূমির অন্যায় ইজারা, ভূ-প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তন, করপোরেট কৃষির দ্রুত বিস্তার, উজানে বাঁধ ও কয়লা খনি প্রকল্প, লোভ ও লাভের বাণিজ্যিক আগ্রাসন, প্রতিবেশীয় নীতি ও সনদের লঙ্ঘন, হাওর প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিবেচনা না করে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, সব মিলিয়ে হাওরের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আজ হুমকিতে। কিন্তু এসব নিয়ে পড়াশোনা কিংবা গবেষণা নেই। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণায় বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক ফ্যাকাল্টি কি আছে? নেই। কিন্তু থাকা উচিত ছিল না?
প্রায় এক যুগ ধরে আমরা জেনে আসছি, কৃষকের উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন শুনি উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কৃষক ধান বিক্রি করছেন। সেচ, বীজ, সারের সংকটের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ধানকাটার মজুরের ঘাটতি। অবশ্য কৃষি শ্রমিকরা শহর ও শিল্পমুখী হওয়াতে এই সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর সরকার যে ধান-চাল কিনে, সেই সুবিধাও মধ্যস্বত্বভোগীদের ডিঙিয়ে কৃষকের কাছে পৌঁছে না।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষকের ধান মজুত রাখার মতো আর্থিক ও অবকাঠামো সচ্ছলতা নেই। ফলে কৃষকদের একটি বড় অংশকে মাঠ থেকেই ধান বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। আর মজুতদারদের কারসাজিতে দাম যখন বাড়ে, তখন কৃষকের গোলায় ধান নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। মোট জনসংখ্যার প্রায় সত্তর ভাগ এখনো গ্রামে থাকেন। যদিও জাতীয় আয়ের বড় অংশ এখন আর কৃষি নয়, কিন্তু কৃষির সাথে জড়িত দেশের নিরংকুশ প্রধান অংশের জনগণ। কৃষির সাথেই তাদের ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে। এমনকি যারা শহরে বিভিন্ন ধরনের পেশায় জড়িত, তারাও কৃষি ও কৃষকের সমস্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। টেলিভিশনের পর্দায় কিছু সংখ্যক ভাগ্যবান কৃষক ও কৃষি-বুর্জোয়ার উন্নতির কাহিনী ছাড়া বাস্তবে ব্যাপক কৃষক জনগণের ভাগ্যের-যে কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়নি তা প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। ব্রিটিশ ও জমিদারি আমলে কৃষকের সমস্যা যে ধরনের ছিল এখন অবশ্য সেরকমটি নেই। কিন্তু শোষণ-বঞ্চনা থেকে কৃষকের মুক্তি ঘটেনি। খোদ কৃষকের একটা বড় অংশের হাতে তেমন একটা জমি নেই। জোতদার, কৃষি বুর্জোয়া, ধনী কৃষক, অকৃষক শহুরে ভদ্রলোক, মাছ-মুরগী-ফল খামারের ধনী মালিক, এবং রাষ্ট্র- এদের হাতে ব্যাপক কৃষি-জমি জমা হয়ে রয়েছে। জমির বড় অংশ চলে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, হাউজিং প্রজেক্ট, ইটখোলা, চিংড়ি চাষ এবং শিল্প-কারখানার নামে বড় বড় ধনী, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় কোম্পানি ও তাদের রাষ্ট্রের হাতে। জলা-পুকুর-খাল-নদী-হাওর-বাঁওড় প্রভৃতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাট-বাজার-নদী-ঘাট-জলাশয়-হাওর ইত্যাদির ইজারাদারি কৃষকের জীবন-জীবিকার ওপর বড় বোঝা হয়ে রয়েছে।
ধান চাষ করে কৃষক যদি ক্ষতির সম্মুখীন হন, তবু তারা হয়তো আগামীতেও ধান চাষই করবেন। কিন্তু পরবর্তী কৃষক প্রজন্ম এ পেশা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিবে। আজ কৃষি শ্রমিক সংকট হচ্ছে, আগামীতে কৃষক সংকট হবে। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না তা শুধু নয়, তারা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না এটাই বেশি কষ্টের। আর এসব চিন্তায় কৃষকের চোখে ঘুম নেই। যে স্বপ্ন এতোদিন ধরে দেখেছেন কৃষক, সেই স্বপ্ন এখন দুর্দশা হয়ে এসেছে। সবশেষে একটি প্রশ্ন, ফ্যাক্টরির মালিকরা তাদের উৎপন্ন পণ্যের দাম যদি নিজ ইচ্ছায় আমাদের থেকে আদায় করতে পারেন, তবে কৃষক কেন তাদের উৎপাদিত ধানের মূল্য নির্ধারণ ইচ্ছানুযায়ী করতে পারেন না?