বন্যায় স্বাস্থ্য বিপর্যয় ও পুষ্টি সংকট মোকাবিলা

ড. মো. শামীম হায়দার তালুকদার

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের কারণে এটি বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি সাধারণ ঘটনা, যা প্রায় প্রতি বছরই দেশটিকে মোকাবিলা করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মূলত বন্যার সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুমি বৃষ্টির সময়সিমাকে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে ভারি বৃষ্টিপাত এবং হিমালয়ের বরফগলা পানির কারণে বাংলাদেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলোতে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়, ফলে দেশের নিম্নাঞ্চল দ্রুত প্লাবিত হয়। বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উঁচু এলাকাগুলোও প্লাবিত হচ্ছে।

বন্যার প্রভাবে মানুষের জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশে আকস্মিক বা দীর্ঘমেয়াদি প্লাবনের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঘরবাড়ি ডুবে যায় এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছর প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়, যা দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে, বিশেষত ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যা বাংলাদেশের জন্য চরম সংকট সৃষ্টি করেছে। এসব বন্যা শুধু অবকাঠামো ধ্বংসই করেনি, বরং লাখো মানুষকে ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন করে তুলেছে এবং খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসার অভাবে অনেক মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এছাড়াও বন্যার কারণে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি খাত, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ। এই খাত বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি এবং অবকাঠামোগত ধ্বংসের কারণে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেয়।

চলতি বছরের বন্যা পরিস্থিতি পূর্বের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ২১ আগস্টের টানা ভারি বৃষ্টিপাত এবং ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ থেকে আসা ঢলের ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়, যা স্মরণকালের মধ্যে অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নোয়াখালী ও ফেনীসহ দেশের ১১টি জেলার ৭৩টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। এছাড়া দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ফলে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, কৃষকের ফসলি জমি এবং সবজিখেত পানির নিচে তলিয়ে যায়। শিশুসহ প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ পানিবন্ধি অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটায় বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিচ্ছে। পরিমিত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। বেশিরভাগ অঞ্চলে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে নলকূপ ও পুকুর, সেই সাথে হাজার হাজার শৌচাগার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেপটিক ট্যাংক এবং আবর্জনা নিস্কাশন ব্যবস্থা বন্যার

পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র এবং অন্যান্য রোগ জীবাণু দ্রুত পানিতে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে যার মধ্যে, কলেরা, ডায়রিয়া, জন্ডিস, ডিসেন্ট্রি আমাশয় এবং টাইফয়েড অন্যতম। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া গর্ভবতী মহিলারাও পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় তাদের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আমরা জানি যে গর্ভকালীন সময়ে একজন মায়ের বাড়তি খাবারের পাশাপাশি প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, লাল মাংস, ডিম ইত্যাদি খাওয়া জরুরি। কিন্তু বন্যায় তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতে পর্যাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী তারা খাবার গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে অনেক ধরনের শারীরিক জটিলতা সেই সাথে বন্যার ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানিতে আটকে থাকার কারণে হচ্ছে নানা রকম পানিবাহিত রোগ।

পানিবাহিত রোগগুলো যেন মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পরে সেজন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ হলো বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের মাধ্যমে বোতলজাতকৃত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। বন্যা কবলিত যে সকল এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না সেসব এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করতে হবে। একই সাথে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের কাছে খাবার স্যালাইন, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং শুকনো খাবার পৌঁছানো দরকার। ডায়রিয়া হলে মানবদেহে লবণ ও পানির সংকট তৈরি হয়। তখন একমাত্র চিকিৎসা হলো লবণ ও পানির অভাব পূরণ করা। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী যদি হাতের নাগালে খাওয়ার স্যালাইন বা ওআরএস না পায় তাহলে বিকল্প হিসেবে লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ডাবের পানি, ভাতের মাড় এসব পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়াতে হবে। এতে শরীরে লবণ পানির ভারসাম্য ফিরে আসবে।

প্রান্তিক বা গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ চুলায় রান্নাবান্না করে থাকে। বন্যায় রান্নাঘরের চুলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে খাবার রান্না করে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই এই মুহূর্তে পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য পুষ্টিকর শুকনো খাবারই হতে পারে বিকল্প ব্যবস্থা। দ্রুত পুষ্টির অভাব পূরণে শুকনো খাবারের মধ্যে চিড়া, মুড়ি, খই, বিস্কুট, চীনাবাদাম, গুড়া দুধ এবং শুকনো ফল যেমন কিশমিশ, খেজুর ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। এগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ খাওয়া যায় এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের জরুরি পুষ্টি চাহিদা পূরণে এই খাবারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ধরনের শুকনো খাবার কেবল পুষ্টি চাহিদা পূরণেই সাহায্য করবে না, বরং বন্যাকবলিত এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সহায়ক হবে। শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মাধ্যমে সাময়িক সময়ের বন্যা কবলিত এলাকায় পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্য আবাদি জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে যেন পরবর্তীতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

এবারের বন্যায় ফসলি জমি ডুবে যাওয়ার কারণে আমন ধানের চারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমন ধানের চারা প্রস্তুত করতে এক মাসের মতো সময় লাগে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবাদি জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা কৃষকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে। ভবিষ্যতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বীজ কোম্পানি এবং কৃষি উদ্যোক্তারা বিনামূল্যে বন্যা কবলিত এলাকায় কৃষকদের মাঝে নানা জাতের ধানের চারাসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির বীজ বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো দ্রুত পুষ্টিকর খাদ্যের সংকট মোকাবিলা করতে পারবে।

মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে আমিষ গুরুত্ব অত্যধিক। আর আমিষের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো মাছ, মাংস ডিম, এবং দুধ। বন্যার কারণে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের খামার এবং পুকুর ও খালবিলের মাছ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি পশুখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেন পরবর্তীতে কৃষকরা দ্রুত এই খাতে ফিরে এসে দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সমূহের পুনর্বাসন এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই মুহূর্তে সরকারি এবং বেসরকারি সং¯’াগুলোকে একজোট হয়ে সমন্বিত কৌশল অবলম্বন করে কাজ করা প্রয়োজন, এতে করে খাদ্য ও পুষ্টির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট