ঢাকা ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস

দুই মাস পার করলো ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা বিপ্লব করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুর্বিষহ শাসনামলের অবসান ঘটিয়ে দেশকে মুক্ত করে। নিষ্ঠুর এই স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটাতে গিয়ে দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি চিরতরে পঙ্গু ও অন্ধ হয়ে যায়। এই গণবিপ্লবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পেশাজীবী, মুটেমুজুর, রিকশাওয়ালা, হকার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা জীবন বাজি রেখে শেখ হাসিনার পতন ঘটায় এবং তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বনন্দিত নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচার, শাসনসহ সবদিক দিয়ে দেশকে যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। তার উপর দাঁড়িয়েই ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ছাত্র-জনতার বিপুল সমর্থন নিয়ে এবং এটাই এ সরকারের মূল শক্তি। আমরা দেখেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কীভাবে দেশ-বিদেশে অভিনন্দিত হয়েছেন। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন এবং অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। প্রত্যেক দেশ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে থেকে আন্তরিক সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইএমএফ, ইউএসএইড, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেয়ার অঙ্গীকার প্রদান করে। এতে হাসিনার ফোকলা হয়ে যাওয়া অর্থনীতি সবল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্যাংক খাতে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু হয়েছে দুর্গম পথের মধ্য দিয়ে। দুই মাসে সরকার এই পথ কতটা পাড়ি দিতে পেরেছে, তার মূল্যায়ন স্বাভাবিকভাবেই জনগণ করবে।

গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার কতটা বিপ্লবের চেতনা ধারণ করতে পেরেছে, এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া অন্য উপদেষ্টাদের অনেকের মধ্যেই তা ধারণের সক্ষমতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তিনি যে গতিতে ও স্পিরিট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তার সাথে তারা তাল মিলাতে পারছেন না। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম দুই সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ উপদেষ্টা হলেও তারা তাদের সাধ্যমতো কাজ করছেন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ করছেন। তবে জনপ্রশাসন উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তারা গণবিপ্লবের চেতনা ধারণ করতে পারেননি। শেখ হাসিনার গড়ে তোলা জনপ্রশাসন ও আদালত থেকে তার দোসরদের অপসারণ করতে পারেননি। অথচ, গণবিপ্লবের অন্যতম স্পিরিট ছিল, জনপ্রশাসন ও আদালত থেকে শেখ হাসিনার দোসরদের দ্রুত অপসারণ করে ক্লিন করা। তাদের বিচারের আওতায় আনা। এ কাজটি তারা করছেন না। ফলে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তারা কার পারপাস সার্ভ করছেন? পর্যবেক্ষকদের মতে, তাদের কর্মকাণ্ডে শেখ হাসিনা ও তার প্রভু ভারতের ছায়া দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। জনপ্রশাসন ও আদালতে থেকে যাওয়া তাদের দোসরদের কারণেই শেখ হাসিনার দেশে ফেরার কথা বলা হচ্ছে। তিনি নতুন করে বলতে সাহস পাচ্ছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগামী এক মাসও টিকবে না, যা গণবিপ্লবের প্রতি হুমকির শামিল। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যেসব মিথ্যা মামলা দিয়েছে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্বপ্রণোদিত হয়ে সেগুলো প্রত্যাহার করেননি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারেক রহমান যাতে দেশে ফিরতে না পারেন, এজন্য তিনি শেখ হাসিনা ও তার প্রভু মোদির হয়ে কাজ করছেন। গণবিপ্লবের ফসল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই শেখ হাসিনা ও তার প্রভু মোদির দোসররা প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন, নির্যাতনের কথা বলে সংখ্যালঘু হিন্দুদের দিয়ে আন্দোলন, আনসার বিদ্রোহ, পুলিশের আন্দোলনসহ নানা পন্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করা হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্র অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। তারপরও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের অভ্যন্তরে এবং বাইরে চক্রান্ত চলছে। তিনি এসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশের ভাবমর্যাদা উন্নত হওয়া এবং সহযোগিতার আশ্বাস পেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের কর্মকাণ্ডে ধীর গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সরকার বিপ্লবী চেতনা ধারণ করে যে গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তা করতে পারেনি বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। তারা মনে করছেন, এই সরকারের প্রথম কাজ ছিল, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিপ্লবে শহীদ এবং আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা। এ কাজ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। এ কাজটি তারা করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, আহতদের চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব নেয়া ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, শহীদদের পরিবারকে দেখাশোনার উদ্যোগ নেয়া, তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়া। এ কাজগুলো অন্তর্র্বতী সরকারের যেভাবে করার কথা, সেভাবে করা হয়নি। পর্যবেক্ষকদের মতে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বিমানবন্দরে নেমে বলেছিলেন, তার প্রথম কাজ হচ্ছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজটি এখনো পুরোপুরি করা সম্ভব হয়নি। একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করে বলেছেন, এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বলা বাহুল্য, পুলিশ এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তাদের ট্রমা কাটেনি। এক্ষেত্রে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আরও বেশি সক্রিয়া হওয়া বাঞ্চনীয়। দেশের মানুষ নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে অতীষ্ট। এখনও সিন্ডিকেট সক্রিয়। লাগাতার বন্যা, যানজট, যাতায়াত সমস্যা ইত্যাদি সংকটে মানুষের জীবন দুর্বিষহ বললেও কম বলা হয়। এসব বিষয়ে সাফল্যের চেয়ে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি। সরকারের যত কাজই থাক, মানুষের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, সেবা ও কল্যাণের চেয়ে সেসব বড় হতে পারে না। সরকার চেষ্টা করছে বটে, তবে দৃশ্যমান সাফল্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি, আন্তর্জাতিক সমর্থন কোনোই কাজে আসবে না, যদি মানুষ ভালো না থাকে। একথা সরকারকে অনুধাবন করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেয়া। আমরা দেখছি, এ ক্ষেত্রেও সরকার ঢিমেতালে কাজ করছে। নির্বাচন কমিশন এখনো পুনর্গঠিত হয়নি। গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। অথচ, এ কাজগুলো দ্রুত করা দরকার। প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে রাখতে হবে, তাদের কোনো বিদেশি শক্তি বা মিডিয়া ক্ষমতায় বসায়নি। এদেশের ছাত্র-জনতা বিপ্লবের মধ্যেমে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তাদের এই বিপ্লবের চেতনা পুরোপুরি ধারণ করতে হবে। এখানে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিপ্লবী চেতনা ধারণ করলে সাফল্য আসবেই, তাতে সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত