জেন-জির উদ্ভাবন ও প্রজন্মের ভাবনা
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ আন্দোলনের তীব্রতা এবং পূর্ণতা ২০২৪ সালে হলেও কোটা সংস্কার ইস্যুতে ছাত্র-আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতির সংস্কার। কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর জন্য সংরক্ষিত অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এ আন্দোলন দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঢাকার শাহবাগসহ বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে শান্তিপূর্ণভাবে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এবং সোচ্চার দাবির মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে অক্টোবরে একটি নির্বাহী পরিপত্র জারি করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এই পরিপত্রটি বাতিলের জন্য হাইকোর্টে একটি রিট করেন ২০২১ সালে এবং ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর কোটা সংস্কারের পরিপত্রটি বাতিল করে দেন কোর্ট। সরকার পরবর্তীকালে এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে। সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হওয়ার প্রথম তারিখটি ছিল ৪ জুলাই ২০২৪। আদালত পরে শুনানি এক মাস পিছিয়ে দেন। ৬ জুলাই কোটা সংস্কারকারীরা অবশেষে সারা দেশে ‘বাংলা বন্ধের’ ডাক দেয়। দেশজুড়ে এই আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের শোচনীয় পতন ঘটে ৫ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান এবং পরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
এই ছাত্র আন্দোলনে একটি কার্যকরী এবং শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে বর্তমান তরুণ সমাজ, অর্থাৎ জেনারেশন-জি বা জুমারস। ‘জেন-জি’ বলতে মোটামুটিভাবে তরুণ প্রজন্মের তাদেরই বোঝানো হয়, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। জেন-জি নামে কোনো আনুষ্ঠানিক ইতিহাস বা প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন বা আলাদা কোনো দর্শন নেই। ধারণাটি তরুণ প্রজন্মের বাস্তব জীবন অনুশীলনের সঙ্গে ঐতিহ্যগত সামাজিক নীতি বা কাঠামোর একটি আধুনিক মিশ্রণ। জেন-জি একটি উদীয়মান সাংস্কৃতিক এবং দার্শনিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বৈশ্বিক সংকট যেমন ডিজিটাল ডিভাইড, পরিবেশ বিপর্যয়, মানসিক স্বাস্থ্য এবং ধনী-গরিবের বৈষম্যের মতো আধুনিক চ্যালেঞ্জগুলোতে তাদের অনুসৃত ??নীতি প্রয়োগ করে। প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার, জীবনধারার উন্নয়ন এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে আধুনিক পদ্ধতির সঙ্গে জেন-জি তাদের নিজেদের চিন্তাধারা একীভূত করে জীবনযাপনের আরো সুষম এবং সুরেলা উপায় আবিষ্কারের চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত।
জেন-জি ধারণার উদ্ভাবন এবং তার বহুল ব্যবহার বর্তমান সময়ে হলেও সুদূর অতীতে তরুণ প্রজন্মের অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালের মে বিক্ষোভ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদ, যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ রয়েছে। প্রায় দেড় যুগ আগে ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের বীজ বপন করতে তরুণদের সঙ্গে জেন-জির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব ছিল। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়ে আর্থসামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে তরুণ এবং জেন-জির অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আফ্রিকা মহাদেশে কেনিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলন চলমান আন্দোলনে জেন-জির উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য।
অন্য যে কোনো সময়ের তরুণ প্রজন্মের চেয়েও জেন-জি বেশ এগিয়ে এ কথা বলা যায়। কারণ, জেন-জি এরই মধ্যে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, অন্য কোনো প্রজন্ম জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এতগুলো সমস্যার মোকাবিলা করেনি। যেমন ২০০৮ সালের মহামন্দা জেন-জিকে এক অভাবনীয় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করেছে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতা এবং শ্রেণিবৈষম্যের পাশাপাশি ২০২১ সালের মহামারি দ্বারা জেন-জির বড় হওয়ার পথটি জটিল হয়েছে। তদুপরি, জলবায়ু পরিবর্তন জেন-জির ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এসব প্রতিকূলতা জেন-জিকে সাহসী, দ্রুত বেড়ে ওঠা, স্বাবলম্বী এবং নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে শিখিয়েছে।
গ্রেটা থানবার্গের কথাই ধরা যাক। ২০০৩ সালে জন্ম এ সুইডিশ পরিবেশবাদী মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার নিমিত্তে তার জোরালো পদক্ষেপের জন্য বহুল পরিচিত। থানবার্গ মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুইডিশ জাতীয় নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করতে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত স্কুল থেকে অনশনের ঘোষণা দেয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে সমর্থ হয়। সুইডেন ২০১৫ সালের মধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সঙ্গে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত সে প্রতি শুক্রবার জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট চালিয়ে যায়। ২০১৮ সালের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে থানবার্গ ভাষণ দেয়ার পর সারা বিশ্বে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছাত্র-জলবায়ু ধর্মঘট শুরু হয়। বিশ্বমঞ্চে থানবার্গের প্রভাবকে দ্য গার্ডিয়ান এবং অন্যান্য গণমাধ্যম ‘গ্রেটা প্রভাব’ বলে বর্ণনা করেছে। জেন-জির সহজে সংগঠিত হওয়া, তাদের উদ্বেগের বিষয় এবং দাবি-দাওয়া দ্রুত নীতিনির্ধারকদের নজরে আসার কারণ হচ্ছে তাদের কাছে আছে তথ্য প্রচার ও প্রসারের উপায়। জেন-জি তাদের দাবি-দাওয়া এবং কার্যকলাপকে নিয়ে এসেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে তারা সবচেয়ে কার্যকরী ও আরামদায়ক- ডিজিটাল স্পেস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন- ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি যোগাযোগের প্রধান হাব হিসেবে কাজ করছে এ প্রজন্মের জন্য। এসব সহজলভ্য মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্যের প্রচার এবং সংগঠনের কার্যকলাপ গতিশীল করে তুলছে। যোগাযোগের এ মাধ্যমগুলো বিকেন্দ্রীভূত, চাইলেই কেউ সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশের জেন-জি যখন একদফা (সরকার হটাও) দাবি নিয়ে সরব, তখন সরকার সারা দেশের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতে আন্দোলন দমানো যায়নি; বরং আন্দোলনকারীরা যোগাযোগের বিকল্প অনেক পন্থা বের করে নিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়েছে। মুক্ত ইন্টারনেট সেবা যে কোনো মুভমেন্টকে সহজেই বৃহৎ আকার ধারণ ও মুহূর্তেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করে। যেমন স্বৈরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জেন-জির সফলতা পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে উঠে এসেছে বারবার এবং তাদের যৌক্তিক আন্দোলনে উৎসাহ জুগিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ‘সেফার ইন্টারনেট সেন্টার’-২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখায়, ৮ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ বলেছে যে, ইন্টারনেট তাদের যে কোনো যুক্তিসংগত ইস্যুতে পদক্ষেপ নিতে বা অংশীদার হতে অনুপ্রাণিত করেছে। সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ জেন-জি মনে করে যে, দেশ এবং সমাজে তাদের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে। অনুরূপ একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এডেলম্যান গ্লোবালের সম্প্রতি এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ জেন-জি কোনো না কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার। রাজনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত কারণে একটি পণ্য, কোম্পানি, দেশ বা রাষ্ট্রকে বয়কট করার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম এই জেন-জি। সম্প্রতি বাংলাদেশের কোমল পানীয় বর্জনের ডাক দিলে কোকাণ্ডকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, গতানুগতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তরুণদের বিশ্বাস এখন অন্য যে কোনো প্রজন্মের তুলনায় কম। ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে (জেন-জি ও মিলেনিয়ামের মিশ্রণ), প্রচলিত গণতন্ত্রের প্রতি সন্তুষ্টি একবারে তলানিতে। যার ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনীতি নিয়ে জেন-জিকে সোচ্চার হতে দেখা যায় অহরহ।
বাংলাদেশে শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনই নয়, ২০১৮ সালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন ছিল মূলত জেন-জির উদ্যোগ। ঢাকায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর সারা দেশের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের মূল দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক নিয়মের যথাযথ প্রয়োগ। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পুলিশকে সহায়তা করে এবং নিজেরাই সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্যোগ নেয়। সেই সময় শিক্ষার্থীদের সাহসী ও সৃজনশীল আন্দোলন শুধু বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার পাশাপাশি জেন-জির অর্থনৈতিক প্রভাবও অনেক মজবুত। দি ইকনোমিস্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বে ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ কোটি মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে, যার প্রায় অর্ধেক এখন চাকরিরত। যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণকালীন চাকরিরত জেন-জির সংখ্যা এরই মধ্যে বেবি-বুমারস (যাদের জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে) প্রজন্মকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেন-জি যখন পুরোপুরি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, তাদের ব্যয় যা আজকের বাজারে ৯ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩০ সালে ১২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পাবে। তবে এ বাজারটা শুধু পশ্চিমা বিশ্বেই সীমিত থাকবে না, এটি বিস্তৃত হবে উদীয়মান অর্থনীতি পর্যন্ত। এর মানে হচ্ছে যে, আগামী দিনের ফ্যাশন থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্যের বাজার আবর্তিত হবে জেন-জি ঘিরে।
শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ছয় হাজারের বেশি জেন-জি-এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এবং এক হাজারের বেশি রাজনীতিবিদ রয়েছে। এ প্রজন্ম যত বড় হবে তত বেশি প্রভাবশালী হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে। জেন-জির এই প্রভাব যদি সমাজের মঙ্গলে কাজে লাগানো যায়, তবে আগামী দিনের পৃথিবী সুন্দর এবং শান্তিময় হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবা : ০১৯৬৩৬৭১৯১৭