প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দাবি কতটুকু যৌক্তিক

এন ইউ প্রিন্স

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষক হচ্ছেন সেই জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। শিক্ষক দিনে দিনে তার মেধা, শিক্ষা, বুদ্ধি, আচরণ, দর্শন, ধৈর্য, সহানুভূতি, সোহাগ ও শাসন ইত্যাদি দিয়ে তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলেন। শুধু গড়ে তুলেই তিনি ক্ষান্ত হন না, তিনি তার শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়তই অনুপ্রাণিত করেন। এমনকি শ্রেণিতে সবথেকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এই কাজ তাকে করতে হয় প্রায় প্রতিদিনই। যেই পিছিয়ে পড়া ছাত্র সম্পর্কে তার পিতামাতাও অনেক ক্ষেত্রে আশাহত হন, তাকেও অনেক সময় শিক্ষক পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, অনুপ্রাণিত করে, আলাদাভাবে বুঝিয়ে, তার পেছনে আলাদা সময় ব্যয় করে তাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এরকম উদাহরণ সমাজে রয়েছে অসংখ্য। এজন্যই শিক্ষক সম্পর্কে ডরষষরধস অৎঃযঁৎ ডধৎফ বলেছেন, ‘The mediocre teacher tells. The good teacher explains. The superior teacher demonstrates. The great teacher inspires.’ অর্থাৎ ‘সাধারণ শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক ব্যাখ্যা করেন, উচ্চতর শিক্ষক প্রদর্শন করেন এবং মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন।’ শিক্ষক প্রতিনিয়ত তাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিশুদের ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা ও জ্ঞানের দুয়ার বিকশিত করেন। আর এই শিশুরাই পরবর্তীতে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেয়। অর্থাৎ শিক্ষকই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেপথ্যে থেকে জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক সমাজ চরমভাবে অবহেলিত রয়েছেন। আর এই বৈষম্যের চরম পর্যায়ে রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে ১ম স্তরের শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতার তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরছি : সারা বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা- ৬৫ হাজার ৫৬৭টি এবং কর্মরত মোট শিক্ষক- ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৯৮১ জন। এরমধ্যে, এসএসসি পাস ১১ হাজার ৭৩৬ জন, এইচএসসি পাস ৫৩ হাজার ১৪৪ জন, ম্যাটস ৩৮ জন, নার্সিং১৬ জন। বাকি ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭ জন শিক্ষক কমপক্ষে স্নাতক পাস! এরমধ্যে, পিএইচডি-এমফিল ডিগ্রিধারী রয়েছেন ৩৬ জন। মাস্টার্স পাস রয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৯ জন, স্নাতক (সম্মান) ২১ হাজার ৪৩৫ জন, স্নাতক (পাস) ১ লাখ ৪ হাজার ৬১ জন, এমবিএ ডিগ্রিধারী ৫ হাজার ৯২৪ জন, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ১ হাজার ৪৫৮ জন, বিএসসি ইন এগ্রিকালচার ৩০৯ জন, বিএসএস ডিগ্রিধারী ১০ হাজার ৮৫ জন, কামিল ৫ হাজার ৭২৮ জন, ফাজিল ১৯৯৬ জন, এলএলএম ৩৩৫ জন, এলএলবি ৩০৮ জন, বিএড (অনার্স) ২৯৬ জন, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ১৩৩ জন। আগামী চার বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন ২০ হাজারের বেশি শিক্ষক।

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে স্নাতক ২য় শ্রেণি বা সমমান। এই একই যোগ্যতায় সরকারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড বা ৩য় শ্রেণির করে রাখা হয়েছে। যা একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে সমাজে নিজের পেশার পরিচয় দিতে সবসময়ে তাকে হীনমন্যতায় মস্তক অবনত হতে হয়। অথচ একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে কতটা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে তার পেশার সার্থকতা বজায় রাখতে হয়। তাকে প্রতিনিয়ত শিশুদের সাথে ডিল করতে হয়, যেখানে একজন বাবা-মাকে তাদের ১-২ জন সন্তানকেই সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ গড়ে ৯০/১০০/১৫০/২০০ জন ছাত্রছাত্রীদের সাথে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪.১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাটাতে হয় (যদিও শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বিদ্যালয়ভিত্তিক ভিন্নতা রয়েছে)। তাদের অভাব-অভিযোগ, নালিশ-বিচার, আবদার-আহ্লাদের কথা শুনতে হয়, তার প্রতিকার করতে হয়। এতটা মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পরেও এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ১৩তম গ্রেডে ৩য় শ্রেণির করে রাখা হয়েছে।

যেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তাকে মাত্র ১৭ হাজার ৫৬০/- টাকা বেতনে চাকরি জীবন শুরু করতে হয়। যার জন্য তার জীবনযাপন করতে বর্তমান বাজার দরের সাথে তাল মেলাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ব্যয়ের সাথে আয়ের অনুপাত ব্যস্তানুপাতিক বা নিম্নমুখী। এজন্য দেশের অধিকাংশ শিক্ষকই বর্তমানে ঋণে জর্জরিত রয়েছে। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ও মর্যাদার জন্য ১০ম গ্রেড দাবি করে সারা বাংলাদেশে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১০ম গ্রেডের দাবিতে যে যৌক্তিকতাগুলো সামনে আনছেন তা নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি :

১. প্রথমত ১০ম গ্রেড প্রদান করা হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের সমাজে সম্মানজনক অবস্থান তৈরী হবে। একইসাথে শিক্ষক আর্থিক দিক দিয়েও সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। যা তার মানসিক সন্তুষ্টি অর্জনে ও নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রতি মনোনিবেশে সহায়তা করবে। ১০ম গ্রেডে উন্নীত হলে একদিকে যেমন শিক্ষকের হীনমন্যতা দূর হবে, অন্যদিকে তার পাঠদানে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে। ২. ১০ম গ্রেড পেলে একজন শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে। ১০ম গ্রেডে একজন শিক্ষকের বর্তমান বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রারম্ভিক বেতন হবে (১৬০০০+৭২০০+১৫০০+২০০+১০০০ (বিশেষ প্রণোদনা) =২৫,৯০০ টাকা প্রায়) যেখানে বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে বেতন মাত্র ১৭ হাজার ৬৫০ টাকা।

৩. বর্তমানে শিক্ষকদের নিয়োগের যে যোগ্যতা দেয়া আছে, অনুরূপ যোগ্যতায় বিভিন্ন সেক্টরে অনেকেই দশম গ্রেড পাচ্ছেন, (যেমন হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক, পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর, হাসপাতালের নার্স, উপসহকারী কৃষি অফিসার ইত্যাদি)। আবার একই কারিকুলাম, একই পাঠ্যবই, একই দপ্তর, একই নিয়োগ যোগ্যতা, একই পদে চাকরি করে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাদের গ্রেড ১০ম অথচ সমগ্র বাংলাদেশের বৃহৎ অংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তারা ১৩তম গ্রেড! এই বৈষম্যের সংস্কার হওয়া অত্যাবশ্যক। সুতরাং ১০ম গ্রেড পাওয়া প্রাথমিক শিক্ষকদের অধিকার।

৪. যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততবেশি উন্নত। শিক্ষার বীজ বপন হয় প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর মাধ্যমে, কোমলমতি এসব শিশুদের প্রতি ধৈর্য সহকারে সর্বাধিক যত্নের জন্য যে শ্রম প্রদান করা হয়, সেই শ্রমের পারিশ্রমিক দশম গ্রেডের বিকল্প নয়। ৫. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে অনেক সময় বাধ্য হয়েই মানুষ একাধিক পেশাকে বেছে নেয়। শিক্ষকেরা ১০ম গ্রেড পেলে অন্যকাজ (যেমন ব্যবসা, খামার, ফার্মেসি, পারিবারিক কাজ বা কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজ ইত্যাদি) থেকে মনোযোগ সরিয়ে পাঠদানে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারবেন। যা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ৬. অনেক মেধাবী শিক্ষকেরা প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে জবে আসেন, কিন্তু সুযোগ পেলেই অন্য যে কোন জবে সুইচ করেন, এসব মেধাবী শিক্ষকদের প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষা সেক্টরে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ১০ম গ্রেডের কোন বিকল্প নেই।

শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দেয়া হলে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পিএসসির হাতে চলে যেতে পারে। তখন বিসিএসের মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীরাই পেশা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেঁছে নিবেন বলে বিশ্বাস। আর মেধাবীরা এই জবে যত আসবে তত এই বিভাগের থেকে ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা খাতটির উন্নয়ন হবে। এক্ষেত্রে কোটা একটি বড় বাঁধা, যদিও এটার সংস্কার হচ্ছে বা হবে। ৭. উন্নত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা ভিত্তিস্বরূপ, বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদেরই সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয় এবং শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রাখা হয়। সমগ্র এশিয়াতেও এমনকি আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতেও প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা অনেক উন্নত। সেসকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন বেতন বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদেরই। একইসাথে তাদের ৩য় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত হলে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকার গ্লানী কিছুটা হলেও কমবে। ৮. অন্যান্য সেক্টরে নির্দিষ্ট সময় পর পর যেমন পদোন্নতির সুযোগ আছে, প্রাথমিক শিক্ষা সেক্টর বৈচিত্রপূর্ণ না হবার কারনে এই সেক্টরে তেমন পদোন্নতির সুযোগ নাই। গড়ে প্রতি স্কুল থেকে ৫ জন শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হবেন মাত্র একজন, সহকারী শিক্ষা অফিসার হবেন মাত্র ০.১ শতাংশ। সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, সারাজীবন পদোন্নতি না পেয়েই কাটাচ্ছেন প্রায় ৮০ শতাংশ সহকারী শিক্ষক। এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক স্কেল ১০ম গ্রেড হওয়া অন্যান্য যেকোনো সেক্টরের তুলনায় বেশিই যৌক্তিক। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্লক পোস্ট বিধায় ও পদোন্নতি না থাকায় শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়নে দ্বিতীয় শ্রেণীর স্বীকৃতি লাভ খুবই যৌক্তিক। ৯. শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ হলে, শিক্ষক জাতির মস্তিষ্ক স্বরূপ, মেধাবী তৈরির কারিগরদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করা সমাজের ও রাষ্ট্রের সকলের নৈতিক কর্তব্য। মূলত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্মানের সাথে ঢেলে সাজাতে হবে এমনভাবে যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের পরিচয় দিতে কখনো সংকোচ বোধ না করেন। তারা যেন কখনো হীনমন্যতায় না ভুগেন। শিক্ষককে নিয়ে যেন আর কোন ঊর্ধ্বতনরা মশকরার সহিত বলতে না পারেন- ঘটনাচক্রে শিক্ষক। তাই মর্যাদার জন্য ও সম্মানের জন্য হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ন্যায্য দাবি। ১০. এই সেক্টরে বেশিরভাগই গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষক। আবার অনেকেরই অনার্স ও মাস্টার্সে খুবই ভালো রেজাল্ট। আবার এই সেক্টরে যোগদান করার পর সকল শিক্ষককে সিইনএড, ডিপিএড ও বর্তমানে বিটিপিটিসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আপডেট থাকতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- তবুও কেন কর্তৃপক্ষ আমাদের ১০ম গ্রেড দিতে চায় না? কেন আমাদের প্রধান শিক্ষক নন ক্যাডার থেকে নেয়া হয়। একটা সাধারণ যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়, এই সেক্টরে লোকবল বেশি, তাই ১০ম গ্রেডে বেতন দেয়া হলে সরকারের কোষাগারে-খাজাঞ্চিতে টান পড়বে, অথচ অনেকেরই জানা নেই বর্তমানে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকেরই বেতন বছরে বছরে ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হয়ে ১০ম গ্রেডের স্কেলেই চলে গেছে। ১০ম গ্রেড হলে সম্প্রতি যোগদানকৃত শিক্ষক ও নতুন যোগদানকৃত শিক্ষকরাই আর্থিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। আসলে ১০ম গ্রেড প্রাপ্তি শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের আর্থিক সুবিধার জন্য নয় বরং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যও দরকার। ১১. আবার প্রমোশনের ব্যাপারটাও পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একটা মানুষ দীর্ঘ বছর চাকরী করার পর সে কোন প্রোমোশন পান না। এরজন্য যারা নতুন যোগদান করেছে বা ভবিষ্যতে করবে তারাও তো ভবিষ্যতে একই বৈষম্যের শিকার হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মেধাবীরা কীভাবে এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি আকৃষ্ট হবে? তারা যখন দেখবে তাদের একই ব্যাচের ফ্রেন্ডসরা রাষ্ট্রের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে যোগদান করে প্রতিনিয়ত প্রমোশন পাচ্ছে, আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা পাচ্ছে, এমনকি তাদের জুনিয়ররাও প্রমোশন পেয়ে তাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কি তাদের মনে ক্ষোভ জন্মাবে না? তাদের কি ভালো লাগবে? কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমনটাই হচ্ছে এই বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে। এখনও এমনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা আছেন যারা ১৫ থেকে ২০ বা তারও অধিক বছর ধরে এই ব্লক পোস্টে জব করে যাচ্ছেন। এমন উদাহরণও আছে যে, অনেকে এই সহকারী শিক্ষক পোস্টে যোগদান করে এখান থেকেই অবসরে গিয়েছেন! জাতির কাছে প্রশ্ন, এভাবেই কি দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশাকে অনাকর্ষণীয় করে রাখা হবে?

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা একজন শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে সততা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা এবং পরিশ্রমের মূল্যবোধ সৃষ্টি করাই একজন শিক্ষকের প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষক যখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকান, তখন তাদের কৌতূহল, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা শিক্ষককে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করে। শুধু শিশুদের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও আগ্রহের কারণেই শিক্ষকতা পেশার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষক হিসেবে তাদের কাজ শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান বিতরণই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো এবং নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া। এজন্য তাদের প্রয়োজন ধৈর্য, সহানুভূতি এবং সীমাহীন ভালোবাসা। আর এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তবে মনে রাখতে হবে, যেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরেও আর্থিক এবং সম্মানের কারণে অন্য কোন পেশাতে যেতে চাইবে না, যেদিন একজন মেধাবী তরুণ-তরুণী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার স্বপ্ন দেখবে?, সেদিনই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। আর এই পোস্ট ও জবকে তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় করার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে দেশকেই। তাহলেই মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হবে শিক্ষকতা পেশা।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, হাওলাদার ডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদরপুর, ফরিদপুর।