বন্যার্তদের হাহাকার ও কৃষকের দুশ্চিন্তা দূর করা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এ দেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও পাহাড় ধসের মতো বড় দুর্যোগ প্রায়ই আঘাত হানছে। তাতে বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। অনেক প্রাণহানি ঘটছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে বিস্তর। এর পরিসংখ্যান হালনাগাদ সংরক্ষণ, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট প্রণয়ন, অর্থায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন ইত্যাদি এখন সময়ের দাবি। এসব লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করা উচিত। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। আকস্মিক এই বন্যায় এর মধ্যেই ভেসেছে ১১টি জেলা। তার আশপাশের জেলাগুলোতেও রয়েছে বন্যার প্রভাব। তাতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫৯ জন। দুর্বিষহ ক্ষুধা আর রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আরো অসংখ্য মানুষ। যারা পেরেছে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচুস্থানে, হাটে, স্কুলে, বাঁধে, বড় সড়কে কিংবা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি, তাদের চোখের পানি বন্যার পানির সঙ্গে মিশে হয়েছে একাকার।

তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ধানখেত তলিয়ে গেছে। পুকুর পরিণত হয়েছে অথৈ শায়রে। মাছ, হাঁস-মুরগি, গৃহপালিত পশু ভেসে গেছে সবই। তাদের খাদ্যের অভাব, সুপেয় পানির অভাব, ওষুধের অভাব, কাপড়ের অভাব বন্যাকবলিত এলাকায় তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। কেউ কেউ আকাশের পানে তাকিয়ে তাদের সৃষ্টি ও পালনকর্তাকে ডাকছে। এরই মধ্যে অনেক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছে অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি। কৃষিবহির্ভূত ক্ষুদ্র্র কারখানা ও কুটিরশিল্পও থেমে গেছে।

অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট নেই। গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যায় কৃষি খাতের যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা দৃশ্যমান। অনেক এলাকায় পাকা আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমন ধানের ক্ষেত সবই ডুবে গেছে। কুমিল্লা জেলায় মোট ৮ হাজার ৬৭৪টি বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় এসব বাড়িঘরের বেশিরভাগই বানের স্রোতে ভেসে গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুড়িচং উপজেলায়। মোট ৪ হাজার ১৪৩টি ঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুমিল্লা সদর উপজেলা, চৌদ্দগ্রাম, মনোহরপুর উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ৭৪ হাজার ৮১টি। টাকার অঙ্কে ১ হাজার ৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বন্যার পানি কমার সাথে সাথে নিজ বসতবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে অনেকেই। বন্যা পরবর্তী এলাকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পুনর্বাসনের কাজ। বসতবাড়ি এখনও কর্দমাক্ত, তাই গৃহ মেরামতে সমস্যা। রাস্তাগুলোর অবস্থা এতটাই করুণ যে, স্বাভাবিক চলাচল করতেও সমস্যা হচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে বিশাল বিশাল গর্ত। পায়ে হাঁটাও দুষ্কর। অনেকের মূল্যবান গাছগাছালি মূলসহ বানের পানিতে উপড়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর, যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা হবে। ফসলের মাঠে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়েকদিন আগেও ফসলের সবুজের সমারোহ ছিল। ভালো ফলন হবে, এমন আশায় স্বপ্নের দিন গুনছিল কৃষকরা।

কিন্তু বন্যার পানিতে সব ফসল বিনষ্ট হয়েছে। পানি নামার পর দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। মাঠের পর মাঠ ঢেকে গেছে নদীর বালির স্তূপে। নিচু জমিতে বালির ঢিবি তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় বালিতে জমির আইলও ঢেকে গেছে। বালির স্তূপ না সরালে জমি চাষাবাদ সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তায় কৃষকের মাথায় হাত। জমি চাষাবাদযোগ্য করতে হলে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। কারণ, জমিতে দেখা যাচ্ছে তিন থেকে চার ফুট বালুর স্তূপ। এগুলো অপসারণ করা না হলে আগামী পনের থেকে ২০ বছরেও এসব জমি চাষযোগ্য হিসেবে তৈরি করা যাবে না। সবাই কিন্তু আমন রোপণের কাজ শেষ করেছিল। রোপণকৃত আমন ধান একেবারে বিনাশ হয়ে গেলেও নতুন করে বীজতলা করা সম্ভব হচ্ছে না।

কৃষকদের ভাষ্যমতে, সংরক্ষণে বীজধান নেই। তাছাড়া বীজ বপন করে চারা গজাতে গজাতে আমনের সিজন শেষ হয়ে যাবে। তাই অনেক কৃষককে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ধানের চারা অধিক মূল্যে সংগ্রহ করতেও দেখা যাচ্ছে। এ সংখ্যা ৫ শতাংশ হতে পারে। ৯৫ শতাংশ কৃষক এবার বন্যার জন্য আমন চাষ করতে পারবে না। না পারার অন্যতম কারণ জমিতে বানের পানি না সরার কারণে রোপণ করা যাবে না। খাল ভরাট হয়ে বহুপূর্বে পানি নামার রাস্তা বন্ধ। খালের উপর অনেকে বাড়িঘর, দোকান তৈরি করে খাল দখলে নিয়েছে। জমিতে পানি থাকার কারণে আমন রোপণ করা যাচ্ছে না। তাই শ্রম বাজারও নিষ্ক্রিয়। পানি নামতে নামতে আমন রোপণের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাঠে আমন চাষবিহীন থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফসল বিহীন কৃষকদের অবস্থা আরো জটিল হবে। নিশ্চিত খাদ্যাভাব দেখা দেবে। বন্যার পানি নামার সাথে সাথে যখন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষরা, তখনই দেখা দিয়েছে তীব্র গরম। শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট।

কৃষকের চাষাবাদের খরচ মেটানো এবং বিনিয়োগে সহায়তার জন্য সহজ শর্তে কৃষিঋণ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে পি কে এস এফ এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্তমানে বন্যার্ত মানুষের প্রধান সমস্যা হলো নগদ টাকার অভাব। অথচ যে কোনো কাজে প্রয়োজন হচ্ছে নগদ টাকা। এই জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য দিতে হবে নগদ আর্থিক সহায়তা। আমাদের দেশে বিভিন্ন ত্রাণ কমিটি বন্যার্তদের পাশে গিয়ে সাধারণত কিছু শুকনো খাবার, পানি ও কাপড় দিয়ে থাকে। নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা তেমন ভাবে না। সরকারিভাবে এ ক্ষেত্রে কিছু নগদ অনুদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রায়ই কৃষি বিমার কথা বলে থাকি। তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। বন্যার পর নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। বাংলাদেশ এখন একটি উচ্চ মূল্যস্ফীতিকাল অতিক্রম করছে। গত জুলাই মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির মাত্রা ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ১৪.১০ শতাংশ। বিগত দশকের মধ্যে এটাই ছিল বড় মূল্যস্ফীতি। বন্যার কারণে এর মাত্রা আরও বাড়তে পারে। তবে এর মধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিরোধক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে। তাতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে অদূর ভবিষ্যতে। তবে এর সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। বাজারে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধির ওপর। এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দরকার। সামাজিক সুস্থিরতা নিশ্চিত করা দরকার।

বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে বাসস্থান, কৃষি, মৎস্য ও স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ অবস্থায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা ক্ষতির প্রকৃতি নির্ধারণ করে ফেলেছেন। কৃষি পুনর্বাসনের প্রয়োজনে তারা তাদের কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করে ফেলেছেন। সংশ্লিষ্ট বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সহ খাদ্য মন্ত্রণালয়ও কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বিশেষ করে কৃষকের চাষাবাদের খরচের ব্যাপারটি নজরে রাখতেই হবে।

পরিশেষে বলব, কৃষকরা যাতে তার জমিগুলো চাষাবাদযোগ্য করতে পারে, সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে সাহায্য করা না হলে এ জমিগুলো চাষাবাদযোগ্য করতে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হবে। গৃহহীনদের তালিকা যেহেতু হয়েছে, যারা এখনও নদীর বাঁধে অবস্থান করছে, তাদের ঘরগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করে দিতে হবে। যারা আমন ফসল রোপণ করতে পারবে না, সেই পরিবারগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা যেতে পারে।

পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা স্বরূপ সহজশর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো, খাদ্য ও পানির সংকট এবং রোগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিচ্ছে। এ মানসিক সমস্যাগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যদি তা সময়মতো মোকাবিলা না করা হয়, বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতি যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে; তা পুনরুদ্ধারে যদি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে দরিদ্র ও বেকারত্বের হার আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। যা কারো কাম্য নয়।

[email protected]