অর্থনীতির রূপান্তর : নতুন সম্ভাবনার উন্মোচন

মিজানুর রহমান মিজান

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যার ফলে দেশের অর্থনীতির সংকটজনক অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে। দেশের অর্থনীতির দিন দিন খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ গুলোর অন্যতম মূল্যস্ফীতি। দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে দেশকে উত্তরণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি ৯-১২ শতাংশ অতিক্রম করেছে, যা জনগণের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যে বড় ঘাটতি রয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করছে। সেইসাথে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এত বাড়ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলভিত্তি শক্ত করে তুলতে ঋণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সংকটগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে। প্রথমত, সুদের হার বৃদ্ধি এবং বাজারের ওপর কঠোর নজরদারি করতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দ্বিতীয়ত, বৈধ রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজতর করা এবং হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা এবং তাদের জন্য দেওয়া সুবিধাগুলো পর্যালোচনা করা। চতুর্থত, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনা করে সহায়তা গ্রহণ ও অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা। পঞ্চমত, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্বনির্ভরতা বাড়ানো, যাতে আমদানিনির্ভরতা কমে। ষষ্ঠত, সরকারি ও বেসরকারি খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা বাড়ানো। সপ্তমত, বাজারের অস্বচ্ছতা কমাতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সঠিক নীতিমালা তৈরি করা। অষ্টমত, জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উন্নয়ন করা। এসব কৌশল কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হবে। মূলত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ত্বরান্বিত করতে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলো হলো, মুদ্রানীতি মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার সমন্বয় করে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি করে ঘাটতি কমাতে হবে, যেমন কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো চেষ্টা করতে হবে। সেইসাথে বাজারে পণ্যের দাম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে পণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সরকারি নীতির মাধ্যমে খাদ্য ও অপরিহার্য পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করতে হবে এবং কৃষকদের জন্য ঋণ ও সহায়তা বৃদ্ধি করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সেবা চালু করতে হবে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য ব্যাংকিং সেবা সহজতর করতে হবে, সেখানে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুবিধা ও কমিশন কম লাগার বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য সহজে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ প্রদান করতে হবে। পেমেন্ট গেটওয়ে উন্নয়ন করতে হবে। যেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা বৃদ্ধি হয়, সেইসাথে দ্রুত ও কম খরচে হয়। তাছাড়া প্রবাসীদের মাঝে বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। রেমিট্যান্স সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোকে একত্রিত করে সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। এই পদক্ষেপ গুলো বাস্তবায়িত হলে বৈধ রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যা দেশের অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করবে। ঋণখেলাপি দেশের অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম এক কারণ। এই ঋণখেলাপি ব্যাংকিং সিস্টেমেকে অস্থিতিশীল করে তুলে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিকভিত্তি দুর্বল হয় পড়ে, যা বিনিয়োগ ও ঋণ বিতরণে বাধা সৃষ্টি করে।

যার ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কমে যাওয়া। এবং এই ঋণ খেলাপির কারণে উৎপাদন ও ব্যবসার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে দিন দিন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায় এবং ঋণখেলাপির ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়, যা বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া সরকার খেলাপি ঋণ মেটানোর জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে বাধ্য হয়, যা সামাজিক ও উন্নয়নমূলক খরচে প্রভাব ফেলে। সেই অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বেকারত্ব বাড়ে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়, যা দেশের স্থিতিশীলতায় ক্ষতি করে। এই কারণগুলোর সমন্বয়ে ঋণখেলাপিরা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে আরো গভীর করে তোলে। যা একসময় পুরো দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াই।

অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করে সেখান থেকে সহযোগিতা নিতে হবে। সেই সাথে সংশোধনমূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সহযোগিতা গ্রহণের জন্য নিয়মিত ভিত্তিতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের ওপর বিস্তারিত তথ্য প্রদান করতে হবে। তাছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যা আন্তর্জাতিকদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। দেশের অর্থনৈতিক সহায়তার সাথে সাথে সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে দেশের অর্থনীতির ত্বরান্বিত করার জন্য কার্যকর সহায়তা লাভ করা সম্ভব হবে।

কৃষি ও শিল্প উৎপাদন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি দেশের খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করে, যা জনগণের পুষ্টির জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া বিভিন্ন শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে, যেমন তুলা, চিনি, ও তেলবীজ। সেইসাথে কৃষি থেকে আয় কৃষকদের জীবনমান উন্নত করে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করে। অপর দিকে শিল্প খাতও দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রেখে আসছে। তাছাড়া শিল্পখাত বিভিন্ন স্তরে কর্মসংস্থান তৈরি করে। এবং শিল্প পণ্য রপ্তানি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ায়। সেইসাথে শিল্প খাত প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎসাহিত করে, যা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করে। কৃষি এবং শিল্প দুটি ক্ষেত্রই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে অপরিহার্য।

সরকারি ও বেসরকারি খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। দুর্নীতি দেশের উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য একটি বড় বাধা। সরকারি-বেসরকারি খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হলে তা নীতি, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতার চর্চা বাড়াতে সাহায্য করবে। শক্তিশালী আইন প্রয়োগ, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তবে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দুর্নীতি রোধে বর্তমান সরকারের কিছু শক্তিশালী আইন এবং নীতিমালা প্রনয়ণ করতে হবে এবং তার কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসাথে সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জনসাধারণের জন্য তথ্যের প্রবাহ সহজতর করতে হবে। মানুষ যেন সহজেই দুর্নীতির অভিযোগ জানাতে পারে তারজন্য সহজ ও কার্যকর প্ল্যাটফর্ম গঠন করতে হবে এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি রোধের উপর প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের দ্রুত তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী সংস্থা গঠন করতে হবে। তাছাড়া দুর্নীতি রোধে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করা এবং সুষ্ঠু নাগরিক সমাজ গঠন করতে হবে। এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারি সেবা প্রদানকে সহজ ও স্বচ্ছ করা। এভাবে, সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ দুর্নীতি রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করছি।

আশা করছি, বর্তমান সরকারের হাত ধরে দেশের অর্থনীতিতে সোনালি দিন আসবে। এই সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়তির সহায়ক হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে, দেশের অর্থনীতিতে সুনালী দিন আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট