নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কবে হবে!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সাথে পরবর্তীতে জনতা যোগ দেয়ার ফলে আন্দোলনটি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রুপ নেয়। যার ফল স্বরূপ ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সপ্তাহখানেক দাম কিছুটা সহনীয় থাকলেও নিত্যপণ্যের বাজারে সবগুলোর নিত্যপণ্যের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী। বিগত আমলের সকল প্রকার দুর্নীতি, অনিয়মের সংস্কার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর অন্তবর্তী সরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজগুলো পর্যাক্রমে চলছে। রাষ্ট্র সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারে এরই মধ্যে ঘোষিত ছয় কমিশনের মধ্যে পাঁচটি কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর গেজেট আকারে সেগুলো প্রকাশ করা হয়েছে।

পাঁচটি কমিশন হলো- নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ কমিটির গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও চিত্র বিনোদন। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজের মধ্যে সবচেয়ে আগে আমাদের খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা সম্পর্কে কাজ করা দরকার। বৈশ্বিক নানান প্রকার প্রভাব আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দিন দিন সংসার চালাতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের সংসার চালাতে প্রায় নাভিশ্বাস উঠছে। লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরছে না কোনো কিছুতেই। পাল্লা দিয়ে দাম বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর। ডিম, মাংসের পর এবার বেড়েছে ‘গরিবের মাংস’ খ্যাত পাঙাসের দাম। সেই সঙ্গে অন্যান্য মাছের দামও বাড়তি। হঠাৎ করে সব কিছুর দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছেন না বিক্রেতারা। এদিকে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে কোনোরকম খেয়ে-পড়ে ঘর সংসার চালানো পরিবারগুলোতে বাড়ছে অস্বস্তি, কমছে সুখ-শান্তি। এসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অনেক কারণ দাঁড় করিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক মহামারীর অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ অব্যাহত, বন্যা, অতি বৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, খড়া প্রাকৃতিক নানান প্রকার দুর্যোগের ফলে কৃষির ক্ষতিসাধন।

‘শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর বাড্ডা-রামপুরা এলাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে পাঙাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়, যা সাধারণত ১৭০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়ে থাকে। এ ছাড়াও আজকের বাজারে রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত, যা সাধারণত ২৮০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেই কিনতে পারা যায়। শুধু পাঙাস আর রুই মাছই নয়, দাম বেড়েছে তেলাপিয়া, পাবদা, চিংড়ি, ইলিশসহ প্রায় সব ধরনের মাছেরই।

সাধারণত মাছের বাজার ঘুরে পাঙাস-তেলাপিয়া মাছেই স্বস্তি মিলতো মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আজকের বাজারে তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত, যা সাধারণত ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে থাকে। এ ছাড়াও বাজারে চাষের কৈ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০, কার্প জাতীয় মাছ ৩৫০-৩৮০, চাষের শিং ৪০০, সাগরের পোয়া ৪০০-৬৫০ ও বাইলা মাছ বিক্রি হচ্ছিল ৬৫০-৭০০ টাকায়।

এ ছাড়াও আজকের বাজারে পাবদা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, বড় সাইজের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। এদিকে গত সপ্তাহের তুলনায় মাছ-মাংসের দাম তুলনামূলক বেশি চাওয়াতে বাজারে বিক্রেতাদের সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছেন ক্রেতারা’। (সূত্র : ঢাকা পোস্ট, ১১ অক্টোবর, ২০২৪)।

ক্যাব বলছে, ‘ভোক্তা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, সরকার ডিমণ্ডমুরগির যে দাম বেঁধে দিয়েছে তা ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়াচ্ছে ঠিকই, ঠকাচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। এখনো বিগত পদ্ধতিতেই দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, যাতে সরকার বদলালেও বদলায়নি বাজারের সিন্ডিকেট’।

বর্তমানে গ্রাম-শহরে কি পরিমাণ ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেছে তা বলাবাহুল্য। রাজধানীর রাস্তাঘাটে শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। রাজধানীসহ সারাদেশের রেলস্টেশন’ বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে, মাজার, বাসাবাড়ি, রাস্তা ঘাটে এমনকি পাবলিক প্লেজসহ সর্বত্রই ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার দৃশ্য খুবিই দুঃখজনক লাগে। কতো রকমের ভিক্ষুক যে ঢাকা শহরসহ সারাদেশে আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। এমনটা আগেও ছিল তবে সংখ্যাটা মনে হয় অনেকগুন বেড়েই গেছে। দেশে নিম্ন আয়ের মানুষজন যে কতো বিপদে তা সহজেই অনুমেয়। অনেক বিশ্লেষক বলছে জনগণের মধ্যে একটা নীরব দুর্ভিক্ষ চলমান।

ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিল বিগত সরকার। প্রথম পর্যায়ে ঢাকার সাতটি এলাকায় এই অভিযান পরিচালানা করা হয়। এরপর পুরো রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা শুধুই কাগজে-কলমে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, কূটনৈতিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে রাজধানীকে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারি পর্যায়ে যেভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।

২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছিল,ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশংকা সংক্রান্তে নানান ধরণের সতর্ক বার্তা দিয়ে রেখেছিল। বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ভুগছে বলে জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের খাদ্যনিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ নানান সমস্যায় ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়ছে। সারা বিশ্ব তেল-গ্যাস,বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সংকটে ভুগছে। বিশ্ব বাজার নিত্যপন্ন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমূখী, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সর্বত্রই যেন একটা মন্দা ভাব ও সংকটের সময় বিশ্বের সাথে আমরাও অতিবাহিত করছি।

পণ্যদ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে সে হারে শ্রমের মূল্য বাড়েনি। যে হারে বাসাভাড়াসহ সার্বিক ব্যয়ভার আমাদের কাঁধের উপর চেপে বসেছে, সে হারে আমাদের আয়ের পরিমাণ বাড়েনি। তাই পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে আমাদের একটা হতাশা নেমে এসেছে। সবাই আয়-ব্যয়ের সমান্তরাল ঠিক করতে নানানভাবে জীবন-জীবিকার ব্যয়ভার কমানোর চেষ্টা করছি। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটার পর অবশিষ্ট অর্থ থাকলে একটু স্বস্তির চিন্তা করে। মৌলিক চাহিদার সবচেয়ে অন্যতম হলো মানুষের পেটে ভাত দরকার। আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমরা কৃষির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সব সময় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

খাদ্য ঘাটতি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করব, কারো কোনো এলাকায় ১ ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ সারা বিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে- আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরো ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আমরা সেই ২০২৩ সাল অতিক্রম করে ২০২৪ সালের প্রায় শেষের দিকে এসে গেছি।

সোনার বাংলার মানুষের সোনার মতো হাসিমাখা মুখ দেখতে সকলের একযোগে অর্থনীতির চাকা সচলে কাজ করতে হবে। খাদ্যের ঘাটতি পূরণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে কৃষি খাতকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করতে হবে। বিশ্বের সাথে আমরাও এ পরিস্থিতি সঠিক পরিকল্পনায় মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব নেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জীবন-যাপনে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে, অপচয় রোধ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে আরো বেগবান করতে হবে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজার ইতিপূর্বেকার সিন্ডিকেটদের দখলে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে আরো। একদল অসাধু ব্যবসায়ী দলীয় নাম ভাঙিয়ে আরো সিন্ডিকেট চক্র বাড়িয়ে তুলেছে। এদেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত্বের সংখ্যা বেশি তাই আমাদের আগে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আগে। দ্রব্যমূল্যের বাজারের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে দ্রত সময়ের মধ্যে। আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নিত্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে সংস্কার জরুরি।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজকোর্ট, খুলনা