শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনে আশান্বিত নাও হতে পারেন; কিন্তু ভয় পাওয়ার কি কারণ আছে? অথচ অনেকেই দেখছি ভয় পাচ্ছেন। শঙ্কিতদের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি খুব করে মাথা নাড়েন এবং বলেন, ‘কই নতুন মুখ তো তেমন দেখছি না, সবাই তো সেই থোড় বড়ি খাড়া, খুব চেনা। যাদের চিনি না তাদেরও চিনি, জানা সবাই। আগে ছিল, আবার সেই মতাদর্শীরাই ফিরে এসেছে। এরা কী করবে জানা আছে আমাদের।’ যুক্তি যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি অনুভূতি। হয়, এই রকমই হয়। ভয় কোনো যুক্তি মানে না, অবৈজ্ঞানিকভাবে ঘোরাফেরা করে।
এটি ঠিক, মহামান্য ও মাননীয়দের পতনের পর পরিবর্তন কোথায় কতটা হয়েছে অতিনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এই ‘অতিনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন’ কথাটাতেও কেমন সরকারি ভাব রয়ে গেছে। সরকারি ভাষায় পরিবর্তন নেই। কেননা, সরকারি ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন নেই। সরকার যায়, সরকার আসে। ব্যবস্থা টিকে থাকে। ভিআইপি রোড ধরে রিকশা কয়েক দিন অবাধে চলাফেরা করেছে বটে, তারপর আবার যথারীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। ঢেউ উঠেছিল, মিলিয়ে গেছে। নদীতে তার চিহ্ন নেই। এটি আমরাও মানতে বাধ্য যে, একদল স্বৈরশাসকের পতন ঘটেছে অবশ্যই। সেটি সামান্য ব্যাপার নয়। একে যারা গণবিপ্লব বলেন তারা বাড়িয়ে বলেন নিশ্চয়ই। তবে পতনটা সামান্য নয়। কিন্তু স্বৈরশাসকরা গেলেও স্বৈরশাসনের ব্যবস্থা যায়নি। আমলাতন্ত্র ঠিকই রয়ে গেছে, যদিও মনে হবে বড় রকমের একটি ধাক্কা খেয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমলাতন্ত্রই দেশ শাসন করবে, একটু প্রচ্ছন্নভাবে হয়তো, কিন্তু মোটামুটি আগের মতোই। তারপরে?
তারপরে কি আমলাতন্ত্র ক্ষমতা হারাবে? না, হারাবে না। আমলাতন্ত্র খুবই স্থিতিস্থাপক, সমঝোতা স্থাপনের ভঙ্গি করে নিজের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখে। ফলে ওপরের ভদ্রলোক গেছেন চলে ঠিকই, কিন্তু নিচে যারা ছিলেন তারা তো রয়েছেন। তারা ধরা পড়বেন তো? বিচার ও শাস্তি হবে তো? কত জনের? বড় বড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন রয়ে গেছে সেখানে। আপাত মুক্তির এই যে আলো, এর পেছনে অন্ধকার রয়েছে বৈকি! একটি নয়, দুটি। একটি অন্ধকার ব্যর্থতার, অপরটি শঙ্কার। একাত্তরে আমরা স্বাধীন হয়েছি, পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের বিদায় করতে পারিনি। সেই লজ্জা জাতীয় সংবিতে এখনও রয়ে গেছে। এবারেও যদি অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে যায়, তবে সে লজ্জা আবারও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে পীড়া হিসেবে। অপরাধীদের যে শাস্তি চাইব আমরা সেটি প্রতিহিংসার কারণে নয়; চাইব ওই অপরাধ যেন আর না ঘটে, ভবিষ্যতে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও বটে। নিরঞ্জন জ্ঞানের প্রয়োজনে নয়, বাঁচার আত্যন্তিক তাগিদেই। অপরাধ ছিল একটি রোগ, যার নিরসন অত্যাবশ্যক।
যে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কারণে পাকিস্তান আমাদের জন্য একটি দুঃসহ বন্দিশালা হয়ে উঠেছিল, সেই আমলাতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশে নষ্ট হয়ে যায়নি, বরঞ্চ ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী হয়েছে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে ও আনুকূল্যে, সেই ব্যবস্থাটির নাম পুঁজিবাদ, যাকে না ভাঙলে জনগণের মুক্তি নেই। পুঁজিবাদই হচ্ছে আসল ব্যাধি, অন্যসব কিছু তার নানাবিধ লক্ষণ ও প্রকাশ। বিগত সরকারপ্রধান দাবি করেছিলেন, তার সরকারই শুধু বৈধ ছিল, অন্য সবাই অবৈধ। কথাটা তিনি মিথ্যে বলেননি। বৈধ বটে, অবৈধ ব্যবস্থার তিনি বৈধ। ব্যবস্থারও বলতে পারেন, ব্যাধিরও বলতে পারেন।
অপরাধীদের আমরা চিহ্নিত করতে চাইব, অপরাধকে চিহ্নিত করার প্রয়োজনে। সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সর্বত্র অসংখ্য অপরাধ ঘটেছে। তাদের চিহ্নিত করা দরকার। তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ হবে সন্দেহ নেই। শ্রেণিবদ্ধ করতে গেলে দেখা যাবে অপরাধগুলো দুই ধরনের। নৈতিক ও অর্থনৈতিক। উভয় ক্ষেত্রেই ওই মহামান্যের বড় কীর্তি ছিল এই যে, জাতিকে তিনি প্রায় নিঃস্ব করে এনেছিলেন।
অর্থনৈতিক দুরাচার আগের সরকারগুলো যে করেনি, এমন কথা নিতান্তই সুবিধাপ্রাপ্তরা ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। তবে এটি সবাই মানবেন যে, আগের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতাতে এলেও বিগত সরকার সর্বকনিষ্ঠ ছিল না; ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ-নিচের দিক থেকে। দুরাচার নয়, ওই সরকারের প্রধান কাজ ছিল লুণ্ঠিত সম্পদ দ্রুত পাচার করা। এ ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরাও হয়তো এতটা ব্যগ্রতা ও একনিষ্ঠতা দেখায়নি।
নৈতিক ক্ষতিটা আরো ভয়াবহ। ওই সরকারের কোনো নীতি ছিল না, দুর্নীতি ভিন্ন। আর সব দুর্নীতির উৎস ছিল একটি নির্দিষ্ট আদর্শ। ভোগবাদ। না, কোনো দার্শনিক অর্থে নয়, একেবারেই স্থূল, শারীরিক অর্থে। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই; অতএব যা পার, যত পার, যেভাবে পার ভোগ করে নাও, বাকিটা পাচার করে দাও বিদেশে, ভবিষ্যতে যাতে ভোগ করতে পার- এই যে একটি স্থির ও দৃঢ়বিশ্বাস এও ছিল ওই মহামান্যের অবিচল আদর্শবাদের একটি অপরিহার্য উপাদান। অতীতে নিপীড়নে যারা নষ্ট হননি, পতিত সরকারের সময়ে তাদের কেউ কেউ যে নষ্ট হলেন ভোগে, তাতে বোঝা যায় ভোগবাদ কত বেশি শক্তিশালী নির্যাতনের তুলনায়। তাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণদের ভোগের ভাগাড়ে আকর্ষণ করার নির্লজ্জ দক্ষতায়।
সৌভাগ্য, আমাদের দেশবাসী এই নৈতিকতাকে গ্রহণ করেনি। সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষুব্ধ হবার হাজারো কারণ ছিল- কিন্তু সর্বজনীন ও সর্বাধিক শক্তিশালী কারণ যেটি ছিল সেটি হলো একটি নৈতিক ঘৃণা। মানুষ এই স্বৈরশাসকের বাইরে ভদ্র কিন্তু আদতে লোলুপ রোমশ ছোক ছোক জন্তুপনাকে ঘৃণা করেছে একেবারে ভেতর থেকে। সংস্কৃতি বিদ্রোহ করেছে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
একটি পরিবর্তন এসেছে। মানুষ অনেক কিছু আশা করছে। সে আশা পূরণ হবে কি? যারা ভয় পান তাদের সংশয়টা এখানেই। বিপ্লব নয় ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন তো একটি হলো। এই পরিবর্তনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যে নেতৃত্ব সেটি আজ কোথায়?
সাতচল্লিশের পরে যা দেখেছি, একাত্তরের পরেও প্রায় তা-ই দেখেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাঞ্ছিত হয়েছে কাদের হাতে? মূলত নব্য ধনীদের হাতে, আলবদর, রাজাকারদের পুনরুত্থান তাদের আশ্রয়েই ঘটেছে, জনগণের আশ্রয়ে নয়। এবারের পরিবর্তনের পরও যদি ধনীদের ধনী হওয়ার এবং জনগণের নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তবে তা দেখে কেউ যদি শঙ্কিত হন তাহলে তাকে দোষ দেব কী করে? কেননা, ক্ষমতায় এসেছেন তারা তো সাম্রাজ্যবাদের কাছে স্বীকার করেছেন পরিকল্পিত অর্থাৎ সুদূরপ্রসারী কূটকৌশল প্রয়োগে এবং জনৈক মাস্টারমাইন্ডের নিরলস প্রচেষ্টায়।
গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হচ্ছে সাম্য, যে কথা লেনিন বলেছিলেন রুশ বিপ্লবের সময়। বৈষম্যই হচ্ছে আমাদের প্রধান সমস্যা। বৈষম্যই স্বৈরতন্ত্রকে রক্ষা করে নিজের প্রয়োজনে এবং গণতন্ত্রের প্রতিহতকরণে। সেটিও নিজের প্রয়োজনেই। অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে মনে করতেন গরিবতন্ত্র; অ্যারিস্টটলের শিক্ষক প্লেটো ভাবতেন গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খতন্ত্র। উভয়েই ছিলেন বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার সমর্থক। অ্যারিস্টটল ঠিকই বুঝেছিলেন, গরিবরাই প্রকৃত গণতন্ত্রী। তবে তাদের গণতন্ত্রপ্রীতি গরিব থাকার আগ্রহের জন্য নয়, দারিদ্র্য মুছে ফেলার ইচ্ছার কারণেই। দারিদ্র্যের যেটা কারণ- বৈষম্য, তাকেও তারা মুছে ফেলতে চায়। শহীদ নূর হোসেন তার বুকে-পিঠে লিখে নিয়েছিল যে দুটি কথা তারা উভয়েই মূল্যবান- ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক;’ কিন্তু তারা পরস্পরের পরস্পর পরিপূরক বটে; স্বৈরতন্ত্র নিপাত না গেলে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে না, আবার প্রকৃত গণতন্ত্রই পারবে স্বৈরতন্ত্রকে পতিত অবস্থায় রাখতে। একদল স্বৈরশাসককে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া গেছে, স্বৈরতন্ত্রের শিকড়গুলো উপড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আরো বড় কর্তব্য, আসলেই।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।