আজ বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস

সাদাছড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অপরিহার্য হাতিয়ার

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিরাপদে পথ চলতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়।

সমগ্র বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে এরূপ নানা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আয়োজনে আজকে দিবসটি পালন করছে। জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার সনদের অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘হাতে দেখলে সাদাছড়ি এগিয়ে এসে সহায়তা করি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দিবসটি উদযাপন করছে। একজন ব্যক্তি নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি’ বলিয়া বিবেচিত হইবেন, যথা: (ক) সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীনতা; অর্থাৎ উভয় চোখে একেবারেই দেখিতে না পারা বা যথাযথ লেন্স ব্যবহারের পরও দৃষ্টি তীক্ষèতা ৬/৬০ বা ২০/২০০-এর কম; বা দৃষ্টি ক্ষেত্র ২০ ডিগ্রি বা উহার চাইতে কম। (খ) আংশিক দৃষ্টিহীনতা; যথা:— এক চোখে একেবারেই দেখিতে না পারা।

(গ) ক্ষীণদৃষ্টি ;অর্থাৎ উভয় চোখে আংশিক বা কম দেখিতে পারা; বা যথাযথ লেন্স ব্যবহারের পরও দৃষ্টি তীক্ষ্ণতা ৬/১৮ বা ২০/৬০ এবং ৬/৬০ বা ২০/২০০ এর মধ্যে; বা দৃষ্টি ক্ষেত্র ২০ ডিগ্রী হইতে ৪০ ডিগ্রীর মধ্যে। লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের মতে সমগ্র বিশ্বে ২৫৩ মিলিয়ন মানুষ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

দেশে সরকারি হিসাবে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৮ লাখ তন্মধ্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ।

সাদাছড়ি দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার যা তাদের অবাধে ও নিরাপদে একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচলে সহায়তা করে। সাদাছড়ি এমন একটি বস্তু যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের গাড়ি চালক ও পথচারীদের কাছ থেকে নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে কাজ করে। চারপাশের জগতকে অন্বেষণ করতে এবং পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বাঁধা এড়াতে শ্রবণ এবং স্পর্শ ইন্দ্রিয়গুলোর পাশাপাশি সাদাছড়ি ব্যবহার করে।

দিবসটি ১৯৬৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দ্য ব্লাইন্ড কর্তৃক সর্বপ্রথম পালিত হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের সাথে কীভাবে সম্মানজনক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে যোগাযোগ বাড়ানো যায়, তাহাই এই দিবসটির মূল উপজীব্য বিষয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবেশগম্যতার বিকল্পগুলো উন্নত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য জীবন এখনও বাধা দিয়ে পূর্ণ। ঠিক যেমনটি হয়েছিল জেমস বিগস এর জীবনে।

তিনি একজন ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার ছিলেন দুর্ঘটনার পরে দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির চারপাশে যানজটের মধ্য দিয়ে যাতায়াতের জন্য সাদাছড়ি ব্যবহার করা শুরু করেন, যা দ্রুতই অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণের পদ্ধতি তৈরি করা হয়।

সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে সাদাছড়িকে যথেষ্ট উন্নত করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সাদাছড়ি ব্যবহারের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যার ফলে এটি তাদের জীবনকে সহজ করে এবং সঙ্গী ছাড়াই তারা চলাচল করতে পারে।

আমাদের দেশে ১৯৭৪ সাল থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা যাতে শিক্ষার সুযোগ পায় এবং তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচির পরিবর্তে স্থানীয় বিদ্যালয়ে চক্ষুষ্মান শিক্ষার্থীদের সাথে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পড়াশোনা করতে পারে এবং নিজস্ব পরিবেশ ও অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলাফেরা করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে সমাজসেবা অধিদফতর ৬৪টি জেলায় ৬৪টি সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ১০। এসব সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে। ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবগুলোই আবাসিক এবং অনুমোদিত আসন সংখ্যা ৬৪০টি।

আবাসিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদন ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। দৃষ্টিগত প্রতিবন্ধিতার কারণে আমাদের সমাজে এখনো মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাঁধার সম্মুখীন হয় এবং সামাজিকভাবে নেতিবাচক আচরণের দ্বারা হেয়প্রতিপন্ন হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আরো নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতিবন্ধিতাবান্ধব ইমারত নির্মাণ, ব্রেইল বই ছাপানো, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতাবান্ধব বিজয় কীবোর্ড উদ্ভাবন।

উন্নত বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ব্রেইল কম্পিউটার, ডিজিটাল টকিং বুক, ই-টেক্সট সফটওয়্যার টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশেও এসব শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষার উৎকর্ষতা ঘটাতে পারলে তাদের জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। সামাজিক সুরক্ষা জন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিসহ সকল ধরনের প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি করে বর্তমানে প্রদেয় ৮৫০ টাকার পরিবর্তে মানসম্মত পর্যায়ে নির্ধারণ করা। প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে তাদের সঞ্চয়পত্র, এফডিআর, ডিপিএস-এর উপর ভ্যাট, কর ও সারচার্জ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা এবং করমুক্ত আয়সীমা ন্যূনতম ৬ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংকোচন করা হয়েছে। আজকের এই বিশেষ দিনে রাষ্ট্র ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে দেশের সকল প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য জোরালো আহ্বান রইলো।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা