খাদ্যনিরাপত্তা : বিশ্ব ও বাংলাদেশ

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একটি টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্যই প্রধান চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশগুলো সমন্বিতভাবে এ সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে কারণ পৃথিবীতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের আগেও ছিল; কিন্তু সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে। যুদ্ধ সবাই শেষ চাইলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ নেই বিপরীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নতুন সৈন্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বড় আকারের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

এই অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য মানুষই দায়ী। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো যে, মানুষগুলো এই সমস্যার তৈরি করেছে তারা কিন্তু খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে না।

খাদ্যে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও ধনী দেশসহ সকলেই ঝুঁকিতে রয়েছে।

সব জিনিসপত্রের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম। বেড়েছে সার ও কীটনাশকের দাম। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সরবরাহ খরচ।

সবদিক থেকে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই বেড়েছে খাদ্য পণ্যের দাম।

গত বছরের তুলনায় এবার তিন ধাপ নেমেছে বাংলাদেশের ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার অবস্থান। ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় ১২৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৮৪তম। বৈশ্বিক এ সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ দশমিক ৪।

সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত (১০৫) ও পাকিস্তানের (১০৯) চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে শ্রীলঙ্কা (৫৬), নেপাল (৬৮) ও মিয়ানমার (৭৪) বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।

সাম্প্রতিক সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের পর ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪ দশমিক ৭। গত বছর সেটি কমে ১৯ এ নেমে আসে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে এসে বাংলাদেশ, মোজাম্বিক, নেপাল, সোমালিয়া ও টোগো তাদের স্কোর ২০১৬ সালের তুলনায় ৫ পয়েন্টেরও বেশি কমাতে সক্ষম হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্ষুধার্ত মানুষ আছে, তা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশ ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি দেশে অপুষ্টির মাত্রা, শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসেব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই চারটি সূচকের মান এক করে ১০০ পয়েন্টের একটি স্কোর পদ্ধতি সাজায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক। সূচক অনুসারে ছয়টি দেশে উদ্বেগজনক পরিমাণে ক্ষুধা বিরাজ করছে। সূচকের সবচেয়ে নিচে থাকা ছয়টি দেশ হচ্ছে- বুরুন্ডি, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, চাদ ও মাদাগাস্কার।

সূচকে শীর্ষ পাঁচ দেশ হচ্ছে- বেলারুশ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন এবং কোস্টারিকা। যুদ্ধের সাথে সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের (ডিডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে সামগ্রিকভাবে ৬০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

অন্য কোনো ফসল কিংবা আমিষ উৎপাদনে এত বেশি পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয় না, যতটা ধান চাষে প্রয়োজন হয়।

দিনকে দিন ভারতে মিঠা পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেশটিতে ধান চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমানে ভারতের মিঠা পানির ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় শুধু ধান চাষের জন্য। এফএওর ২০২৩ সালের স্টেট অব ফুড ইনসিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ বা ৬৯ কোটি ১০ লাখ থেকে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।

কানাডা ও ইউরোপে দাবানল, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকায় খরা, চীনে বন্যা ও ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য সংকট আরো বেড়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি বাড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও খাদ্যপণ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে তো মারাত্মক খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর সাথে মানবসৃষ্ট পরিবেশ এর জন্য দায়ী। কম বৃষ্টিাতের ফলে নষ্ট হয়েছে সোমালিয়ার হাজার হাজার একর জমির ফসল। পানি ও খাদ্যশূন্য হয়ে মারা গেছে কৃষকদের গবাদিপশু। বিশ্বের ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন তীব্র ক্ষুধার্ত।

আর ক্ষুধার্ত মানুষের এই সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একুশ শতকে বিশ্বে আর দুর্ভিক্ষ ঘটবে না বলে বিশ্ব নেতারা প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সোমালিয়ায় আরো একবার দুর্ভিক্ষ আসন্ন। বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিও’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ জন মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ এবং এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এই মন্দার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে।

আমাদের হাতে যুদ্ধ বন্ধ করার বিকল্প নেই। অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যেখানে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্যতা একটি বড় সমস্যা। এই দারিদ্র্যতার কারণেই মূলত ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। করোনার ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ দফায় দফায় লকডাউন থাকায় বন্ধ থেকেছে উৎপাদন কার্যক্রম। মানুষ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছিল, সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে এসেছে। এর সাথে ইসরাইলের সাথে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের একটি ব্যাপক সংঘাতের সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রাচ্যে। একটি বড় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটি ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই আর একটি ধাক্কা মানুষের নাভিশ্বাস ফেলতে বাধ্য করছে।

বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতিদিনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। আগামী কয়েকমাসে পৃথিবী একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো যুদ্ধ এবং এর সাথে বহুদিন ধরে চলে আসা সমস্যাগুলো যেমন- বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং শরণার্থী সংকট। এখন এসব সমস্যা আরও বেশি তীব্র হওয়ার মুখে। কারণ বিভিন্ন দেশ খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়েই তীব্র শরণার্থী সংকট চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থা দাঁড় করা কষ্টসাধ্য।

যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্যের কারণে পৃথিবীতে দারিদ্র্যতা এবং খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে। ভয়াবহভাবে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসাথে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।

সেটা সামাল দেয়া বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জের। দারিদ্র্যতা, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভোগাবে। যদিও এর সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন খরা, বন্যা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। টেকসই খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী এই সময় অত্যন্ত জরুরি। আর তা সম্ভব না হলে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীকে খাদ্য সংকটে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট