ঢাকা ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহার করুন

মো. মিনহাজুর রহমান মাহিম
পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহার করুন

কোনো ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা, মতাদর্শ, বিশ্বাস স্থাপনের জায়গা অনুযায়ী তার আচার-ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে তার মানসিকতা প্রকাশ পায়। সমাজে প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকে বা থাকতে পারে। তবে সমাজের মানুষের অনেক মতই রয়েছে যা তারা আবশ্যকভাবে মেনে থাকে বা সকলে মিলে একই মতাদর্শ অনুসরণ করে থাকে। ওই সকল মতাদর্শগুলোকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ বলে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মতাদর্শের মানুষ রয়েছে যারা সকলে মিলে একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ মেনে চলে। নির্দিষ্ট মতাদর্শের মানুষদের ভিন্ন করার জন্য আমরা জেনারেশনও বিভক্ত করে থাকি। একেক জেনারেশনের মানুষ একেকটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ মেনে চলে এবং তার আশপাশের মানুষদেরও তা মেনে চলার জন্য নির্দেশ বা অনুরোধ করে থাকে। মতাদর্শ বা মানসিকতা নির্দিষ্ট করে মেনে চলা এবং নতুন মতাদর্শ গ্রহণে দ্বিধা প্রকাশ করা ব্যক্তিদের পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষ বলা হয়। পশ্চাৎপদ মানসিকতা সাধারণত পুরোনো প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশের ২০০০ সালের আগের মানুষদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের হার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা অত্যন্ত বেশিই দেখা যায় এবং যেতো। যার কারণে তাদের মধ্যেই পশ্চাৎপদ মানসিকতা বেশি দেখা যায়। তারা পুরোনো কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, নিয়মণ্ডকানুন, রীতি-নীতি মেনে চলে এবং নতুন কোনো মতামত বা নিয়ম সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য এবং সত্য ও সঠিক হলেও তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাদের অধীনস্থ সকলকে এ দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সঠিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পরিবার ও পরিবেশগত প্রভাব ও মূল্যবোধের কারণে তারা পশ্চাৎপদ মানসিকতার হয়ে থাকে এবং এই মানসিকতা দ্বারা সকলের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে থাকে। পুরোনো প্রজন্মের পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার মধ্যে নতুন মতবাদ গ্রহণে অনিচ্ছা, শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারীদের প্রতি বৈষম্য, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা এমনকি সাম্প্রদায়িকতাও দেখা যায়।

২০০০ সালের আগের মানুষদের মধ্যে পুরাতন মতবাদ বিরাজমান। শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন, বিজ্ঞানের নতুনত্ব, আধুনিকতার ছোঁয়ায় আধুনিক চিন্তাধারা গ্রহণে তারা অনীহা প্রকাশ করে এবং ঐতিহ্যগত রীতি-নীতির উপর জীবন পরিচালনা করতে চায়।

আমাদের দেশে ২০০০ সালের আগে শিক্ষার হারও তুলনামূলক অনেক কম ছিল বলা যায়। শিক্ষার হার কম থাকার কারণেও অনেকে এই পশ্চাদৎপদ মানসিকতার হয়ে থাকে।

পশ্চাৎপদ মানসিকতার আরেকটি চরম বৈশিষ্ট্য হলো বাল্যবিবাহ। এখনো গ্রামাঞ্চলগুলোতে অহরহ বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। পশ্চাৎপদ মানসিকতা থেকে যতদিন সরে না আসবে ততদিন এই ব্যাধি চলতেই থাকবে।

যৌতুক প্রথা এই মানসিকতার মানুষদের মধ্যে একটি কমন বৈশিষ্ট্য। যৌতুকের জন্য এখনো অনেক বিয়ে ভেঙে যায়, পারিবারিক কলহ এবং সংসারে অশান্তি চলতে থাকে।

নারীদের সকল সুযোগ সুবিধা সমানভাবে না দেয়া এই মানসিকতার মানুষদের আরেকটি খারাপ বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষদের থেকে কম সুবিধা দেয়া এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করানো এবং চাকরি না করার জন্য পরিবার থেকে বাধা দেয়ার মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্য করাও এই মানসিকতার মানুষদের বৈশিষ্ট্য।

এই মানসিকতার মানুষ প্রচুর অন্ধবিশ্বাস করে থাকে এবং কুসংস্কার মেনে থাকে। কোনো কিছুর ভিত্তি না থাকলেও ঐতিহ্য মেনে চলা ও সামাজিক নিয়মের সাথে গা ভাসিয়ে অন্ধবিশ্বাস করে এবং কুসংস্কার ও কুণ্ডরীতি নীতি মেনে থাকে।

ধর্মান্ধতা পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে প্রচুর দেখা যায়। যেহেতু এই মানসিকতার মানুষরা শিক্ষাগ্রহণ থেকে পিছিয়ে থাকে তাই পুরোনো রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় আবেগ বেশি থাকে এবং ধর্মান্ধতার কারণে মাজার পূজাসহ নানা ধরনের কুণ্ডধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করে থাকে।

সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সমাজে একে অপরের প্রতি বিবেধ, কলহ ও দাঙ্গা লাগানো এই মানসিকতার মানুষদের একটি চরম খারাপ বৈশিষ্ট্য। এক ধর্মের মানুষের অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে না চলা, অন্য ধর্মকে অবজ্ঞা করা ও ক্ষতি করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে থাকে এই মানসিকতার মানুষরা। পশ্চাৎপদ মানসিকতার এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজে নানা ধরনের প্রভাব পড়ে থাকে।

সাধারণত তাদের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অধীনস্থ অনেকেই প্রভাবিত হয়ে থাকেন এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা এর কারণে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

নারীদের সাথে বৈষম্য করার কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ে এবং সমাজের অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের বেড়ে উঠায় বাধা সৃষ্টি হয়।

যেহেতু তারা নতুন মতবাদ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে, তাই তাদের জন্য অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে বাধা সৃষ্টি হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।

যৌতুক প্রথার কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এবং সাংসারিক কলহ তৈরি হয়। এছাড়াও বাল্যবিহের কারণে অনেক মায়ের মৃত্যু, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও শিশুর বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগে থাকে।

অন্ধবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার মেনে চলার কারণে সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকে। আধুনিকায়ন থেকে মানুষ দূরে সরে যায় এবং নিজেদের ও আশপাশের মানুষের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

আধুনিক চিকিৎসা থেকেও এই মানসিকতার মানুষরা দূরে থাকে যার কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যা পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও হতে পারে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও সমাজে দাঙ্গা লাগানোর জন্য তারা প্রচণ্ডভাবে দায়ী এবং তাদের এ কাজের কারণে সমাজের মানুষদের মধ্যে মেলবন্ধন ও যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি হয়ে থাকে।

পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহারের জন্য সমাজে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে। সার্বজনীন ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান আরোহনের মাধ্যমে পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহার করা সম্ভব।

নারীদের যথাযোগ্য সম্মান করতে হবে। যৌতুক প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নারীদের যেসব বিষয়ে ক্ষমতায়ন না করার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় সেসব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হবে।

আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এবং পুরাতন রীতি-নীতি পরিহারের মাধ্যমে এই মানসিকতা থেকে উঠে আসা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকার ও জনগণের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে সরে এসে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ একত্রে মিলে বসবাস করতে হবে। একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে। কারো প্রতি বৈষম্য না করে সকলের সাথে একত্রে মিলে জীবনযাপন করতে হবে। সবশেষে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মানসিকতা থেকে সরে আসা সম্ভব এবং যারা এই মানসিকতার তাদের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ও অন্যান্য অপরাধের কারণে দ্রুততম সময়ে আইন ভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং কঠোর শাস্তি দ্রুততম সময়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করে এই ধরনের মানসিকতা পরিহার করা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত